অক্সিমিটার নিয়ে অনেক কিছু পড়ছি। শুনছি। ব্যাপারগুলো গোলমেলে সন্দেহ নেই। তাই অল্প যতটুকু ফিজিক্স বুঝি, তাই দিয়ে সহজে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কি ভাবে কাজ করে একটা অক্সিমিটার। আশাকরি এটা পড়ার পর আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, মোবাইল ফোনে অ্যাপ দিয়ে কাজটা সম্ভব কিনা!
অক্সিমিটার নিয়ে বলার আগে আমি কয়েকটা সহজ ব্যাপারে বলতে চাই। এর মধ্যে প্রথম হল...
ওয়েভলেনথ বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য কি ? অন্ধকারে রাতের বেলা আমরা কিছুই দেখতে পাইনা। কিন্তু যাদের নাইট ভিশন চশমা আছে তাঁরা একটা কিছু অবয়ব দেখতে পায়, লাল নীল সবুজ রঙের। কারণ হল আমাদের শরীরের তাপমাত্রা। প্রতিটি মানুষের শরীরের উষ্ণতার ওপর নির্ভর করে একটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বেরোয়। ঠিক যেমন লোহাকে গরম করলে লাল হয়, তার মানে এই নয় যে লাল হবার আগে অবধি কিছু বেরোচ্ছিল না। লাল হবার আগে অবধি যে আলো নির্গত হয় সেটা আমাদের চোখ ধরতে পারে না। তাকে বলে ইনফ্রারেড (Infrared) লাইট। এই ইনফ্রারেড হল এমন আলো যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা ওয়েভলেনথ লাল আলোর থেকে বেশী। ঠিক একই পদ্ধতিতে কাজ করে থার্মাল গান। দূর থেকে শরীরের তাপমাত্রা বলে দেয়। অর্থাৎ খুব সহজ করে বললে দাঁড়ায়, আলোর রঙ কি হবে তা নির্ধারিত হয় তরঙ্গদৈর্ঘ্য দিয়ে। একে ন্যানোমিটার এককে লেখা হয়। এক ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ। আমাদের চোখ মাত্র ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটার আলো ধরতে পারে। তার বাইরে যে কোনো আলো আমরা চোখে দেখতে পাইনা। থার্মাল গানে যে ছবি দেখায়, সেটা ৭০০ এর ওপরের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। তাই ওটা কেবল ওই যন্ত্র দিয়েই দেখা সম্ভব। খালি চোখে নয়।
বেগুনী-নীল-আকাশী....বে-নী-আ-স-হ-ক-লা... মনে আছে? এর বেগুনী আলোর ওয়েভলেনথ হল ৪০০ ন্যানোমিটারের মত। আর লাল এর পরিসর ৭০০-র দিকে। এই ৪০০ এর নীচেরগুলোকে বলে আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী আর ৭০০ এর ওপরেরগুলোকে বলে ইনফ্রারেড।
তাহলে বোঝা গেল ওয়েভলেনথ ব্যাপারটার সাথে কোনো না কোনোভাবে রঙ ব্যাপারটা জড়িত।
রক্তের সাথে এর কি কাজ ?
রক্তে, আমরা জানি অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় হিমোগ্লোবিন কণা। হিমোগ্লোবিন যদি গাড়ি হয়, অক্সিজেন হল তার প্যাসেঞ্জার। গোটা শরীরে শিরা আর ধমনীর মধ্য দিয়ে চলাচল করে। এবার রক্তে অক্সিজেন কমে যাওয়া মানে হল হিমোগ্লোবিন গাড়ি চলছে রুটে, কিন্তু প্যাসেঞ্জার নেই। এটা কি ভাবে জানা যায়? উপায়টা খুব সহজ। উত্তর হল এরা কোন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। কোন বস্তু কোন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে সেটা একটা ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর মত। অর্থাৎ আলো পাঠিয়ে যদি দেখা যায় একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নিল,তাহলে সেই বস্তুটা কি সেটা বলে দেওয়া যায়। এটা একটা ন্যাচারাল মিরাকেল, যেটা পদার্থবিজ্ঞানীরা কাজে লাগান।
তাহলে হিমোগ্লোবিনের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কেমন হয়?
হ্যাঁ, এখানেই আসে ইনফ্রারেড আলোর কথা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন হিমোগ্লোবিনে যদি অক্সিজেন থাকে তাহলে সেটা ৯৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশী শোষণ করে। আর যদি হিমোগ্লোবিনে অক্সিজেন না থাকে তাহলে সেটা ৬৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশী শোষণ করে। আচ্ছা আর একটা ব্যাপার, অক্সিজেন থাকলে ৬৫০ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আবার কম শোষণ হয় আর না থাকলে ৯৫০ এর টা কম হয়।
এখানে আর একটা ছোট ব্যাপার আছে, যেটা বিজ্ঞানী ল্যাম্বার্ট এবং বিয়ারের রুল নামে খ্যাত। সেটা বলে যে কনসেন্ট্রেশন বা সমাবেশ যত বেশী হবে, এই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শোষণও তত বাড়বে।
এবার এই দুটোকে এক করলে কি দাঁড়ায়? যদি আমি দেখি, আমার রক্তে ৯৫০ বেশী শোষণ হচ্ছে ৬৫০ এর থেকে তাহলে আমার অক্সিজেন ভালো আছে। কতটা ভালো? সেটাই হিসেব করে বলে দেয় অক্সিমিটার।
অক্সিমিটারে কি থাকে তাহলে?
এই আগের অনুচ্ছেদে যেটা বললাম, সেটারই মিনিয়েচার ভার্সান হল অক্সিমিটার। এতে সাধারণত দুটো LED থাকে, একটা ৬৫০ ন্যানোমিটার আর একটা ৯৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের। অন্যদিকে, একটা ডিটেকটার থাকে যেটা দেখে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর মাত্রা কতটা কমল। আর এই দুটোর মাঝে কি থাকে? আপনার আঙুল-এর ডগা। যেখানে রক্তের পরিমাণ বেশী। এছাড়া এক বা একাধিক চিপ থাকে এই ডেটা হিসেব করে আপনাকে স্ক্রিনে কত পার্সেন্ট হল সেটা দেখানোর জন্য।
তাহলে সাধারণ মোবাইল ফোনে অ্যাপ দিয়ে কি এই কাজ সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব। যদি সেই ফোনে ৬৫০ ন্যানো আর ৯৫০ ন্যানো এই দুই লাইট সোর্স আলাদা ভাবে থাকে। কিন্তু সেটা কোনও ফোনে থাকে না। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট সাদা আলো। অর্থাৎ তাতে ৪০০-৭০০ সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো মিশে থাকে। বে-নী-আ-স-হ-ক-লা মেশালে সাদা হয়। আলাদা করে কিছু নেই। তাই এই পদ্ধতিতে অক্সিমিটার বানানো অসম্ভব। কেউ যদি দাবী করে থাকেন, তাহলে সেই দাবী ভুল এবং পরিমাপ অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশী।
Written by Dr. Pabitra Das,
Scientist and Engineer, X-fab, France.
Comments