পদার্থের চারটি দশা কঠিন, তরল, গ্যাস এবং প্লাজমাকে নিয়ে আমরা হামেশাই আলোচনা করি। এই প্রশ্ন আসতেই পারে মাত্র এই চারটেই কি পদার্থের দশা। না এর বাইরেও অন্য আরও দশা মজুত আছে। এই প্রসঙ্গেই বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেটকে অনেকেই পদার্থের পঞ্চম দশা হিসেবেও গণ্য করে থাকেন। অনেকে ভাবতেই পারেন প্রথমেই কেন আমরা বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেটের প্রসঙ্গ তুললাম। তার কারণ সুপারফ্লুইড (অতিতরল) যা আমাদের শিরোনামে উল্লিখিত আছে, তার সঙ্গে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। আজকাল সুপারফ্লুইড স্টেটস অফ ম্যাটার, বাংলায় বলা যায় পদার্থের অতিতরল দশা বিজ্ঞানের বহু চর্চিত একটি বিষয়। নিম্ন তাপমাত্রার প্রসঙ্গে পদার্থের বিভিন্ন দশা নিয়ে যখন আলোচনা চলে সেখানে সুপারফ্লুইডিটির (বাংলায় বলা যায় অতিতরলতা) তার বিশেষ কিছু গুরুত্ব আছে। পদার্থের এই দশাকে ঠিক-ঠিক বুঝতে গেলে অবশ্য বোস-আইনস্টাইনের মতবাদকেও যথাযথভাবে বোঝা দরকার। প্রথমে বোঝা যাক, এই অতিতরল বলতে আমরা কী বুঝি। খুব সহজ করে বললে, অতিতরল এমন একটি তরল যার ধর্মগুলো সাধারণ তরলের–যেমন তেল, রস, জল–প্রদর্শিত ধর্মের থেকে অনেক আলাদা। অতিতরলের আছে শূন্য ভিস্কসিটি (সান্দ্রতা)। তাই অতিতরল অনায়াসে একটি পদার্থের সারফেসে বা উপরিতলে চলাফেরা করতে পারে, অথচ তার গতি মন্থর হয় না। চলাফেরা করার সময় পদার্থের উপরিতলের সঙ্গে সংঘর্ষে এবং বাধাতে অতিতরলের শক্তির কোনো ক্ষয় হয় না। বিষয়টিকে বোঝার জন্যে দৈনন্দিন জীবনের একটি ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সকালের চা-ভর্তি একটি কাপের কথা দিয়েই এটা বলা যাক। সামান্য চিনি গোলানোর জন্যে পেয়ালার চা একটি চামচের সাহায্যে অল্প সময়ের জন্যে নাড়ানো হলো, তা ঘড়ির কাঁটার দিকেও হতে পারে, অথবা তার উল্টোদিকেও হতে পারে। কিছুটা ঘোরানোর পর আমরা যদি চামচটিকে পেয়ালা থেকে তুলে নিই, তাহলে দেখব কিছু সময় পরে, সেই পেয়ালার চা আর ঘুরছে না, তা স্থির হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই পেয়ালার মধ্যে তরলটি যদি অতিতরল বা সুপারফ্লুইড হয়, সেক্ষেত্রে সেই চামচ তুলে নেওয়ার পরেও, অতিতরল অসীম সময় ধরে ঘুরে যাবে। সাধারণ তরলের ক্ষেত্রে যা ঘটে, তরলের অন্তর্বর্তী তলগুলোর মধ্যে চলাফেরা করার সময়ে ঘর্ষণজনিত কারণে এবং অণু-পরমাণুর একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে একে অন্যের কাছে বাধার সৃষ্টি করে। সেই বাধার কারণেই, সেই সংঘর্ষের কারণেই তাদের চলাফেরার গতি মন্থর হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে সেই তরল আবার স্থির হয়ে যায়। এবং তাপমাত্রা কমানোর সঙ্গে তরলের সান্দ্রতা আরও বেড়ে যায়। এটাই যে-কোনো ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদি তরলের ক্ষেত্রে ঘটবে। ১৯৩৮ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় তরল হিলিয়াম-৪ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নীচে অনায়াসে চলাফেরা করতে পারে কোনো ঘর্ষণ ছাড়াই। একটি পদার্থ চলাফেরা করবে অথচ তাদের অণু-পরমাণুগুলোর পরস্পরের মধ্যে কোনো ঘর্ষণ থাকবে না, এ একটা সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা, পদার্থের একটি নতুন ধর্ম। তাই একে পদার্থের একটি নতুন দশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। অতিতরলের আবিষ্কার তাই স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তৈরির মতোই একটি ঘটনা। আর এটি ঘটে খুব নিম্ন তাপমাত্রায়, মানে ঘরের তাপমাত্রার অনেক নীচে। হিলিয়াম-৪ এর ক্ষেত্রে সেই তাপমাত্রা প্রায় ২.১৭ কেলভিনের নীচে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে নিম্ন-তাপমাত্রায় পৌঁছলে পদার্থের অনেক ধর্মেরই আমূল পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ ঘরের তাপমাত্রায় বিভিন্ন পদার্থ যে ধর্ম প্রদর্শন করে, তাদেরকে অতি নিম্ন-তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে তাদের আচরণ অনেকটাই অন্যরকম হতে পারে। ১৯০৮ সালে কেমারলিং ওনেস হিলিয়াম-৪ কে প্রথম তরলীকরণ করেন। সেই সময়ে হিলিয়ামের আরেকটি আইসোটপ হিলিয়াম-৩ এর অস্তিত্বের কথা অজানা ছিল। হিলিয়াম-৪ তরলীকরণের কয়েক বছরের মধ্যেই এই পদার্থের কিছু অদ্ভুত ধর্মও দেখা গেল তার তরল দশায়। ওনেস তরল হিলিয়াম-৪ কে ক্রমাগত আরো নিম্ন-তাপমাত্রায় নিয়ে যেতে থাকলেন, এই প্রয়াসে যদি হিলিয়াম-৪ তরলকে কঠিন পদার্থে পরিবর্তিত করা সম্ভব হয়। তিনি অবশ্য সফল হননি। এরপর বহু গবেষণার পরে আমরা জেনেছি হিলিয়াম-৪ এমন একটি পদার্থ যা সাধারণ চাপে যত তাপমাত্রাই কমাই না কেন, তা তরল থেকে কঠিনে পরিবর্তিত হয় না। এমনকী শূন্য কেলভিনের খুব কাছে পৌঁছে গেলেও, তা হবার নয়। তরল থেকে কঠিন দশায় পরিবর্তিত হয় না, অন্তত সাধারণ চাপে। ওনেস তাঁর প্রচেষ্টায় আনুমানিক ১ কেলভিনের নীচে যেতে সফল হয়েছিলেন। ওনেস বেশকিছু ইঙ্গিতও পেয়েছিলেন যে হিলিয়াম-৪ কিছু অনন্য ধর্ম প্রদর্শন করে। ১৯২৪ সালে ওনেস তরল হিলিয়ামের ঘনত্ব খুব নিখুঁতভাবে পরিমাপ করেন। তাঁর সেই পরীক্ষা অনুযায়ী তাপমাত্রা কমালে, তরল হিলিয়ামের ঘনত্ব ২.১৭ কেলভিনের কাছাকাছি পৌঁছলে একটি দশাকে অতিক্রম করে। আপেক্ষিক তাপের (হিট ক্যাপাসিটি) পরিমাপ তাপমাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে সেই একই ধরনের অবস্থান দর্শায় ২.১৭ কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রাতে।
আপেক্ষিক তাপ, সাধারণত, পদার্থের বিশেষ কিছু মৌল ধর্ম জানার জন্যে একটি আদর্শ পরীক্ষা। প্রধানত নিম্ন-তাপমাত্রায় পদার্থের বিভিন্ন ধর্মকে অনেক গভীরে জানতে হলে এই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক। যে সমস্ত পদার্থের ইলেকট্রন এবং ইলেকট্রনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুব জোরালো, ইংরিজিতে যাকে বলা যায় কো-রিলেশন খুব বেশি, তাদের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে আপেক্ষিক তাপের পরিমাপ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে সক্ষম। উচ্চ তাপমাত্রায়–যেমন ঘরের তাপমাত্রায়–সমস্ত কঠিন পদার্থের তাপমাত্রার জন্যে ফোনোনের অবদান বেশি থাকে, তাই পদার্থের ধর্ম যা ইলেকট্রনের উপর নির্ভর করে তা অনেকটাই আড়ালে চলে যায়। কিন্তু তাপমাত্রা কমালে সিস্টেমের বিভিন্ন ধর্মের জন্যে দায়ী ফোনোনের অবদান একটু একটু করে কমতে থাকে, আবার অন্যদিকে ইলেকট্রনের অবদান বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন তাপমাত্রায় পদার্থের আপেক্ষিক তাপ পরিমাপ করলে ইলেকট্রনের জন্যে যে বৈশিষ্ট্য থাকে, তা সেই পরীক্ষায় অনায়াসে ধরা পড়ে। ফোনোনকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় একধরনের উত্তেজনা বা এক্সাইটেশন। সাধারণত ৫০ কেলিভনের নীচে ফোনোনের অবদান কঠিন পদার্থে উপেক্ষা করা সম্ভব।
উপরে আমরা আপেক্ষিক তাপ নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু আপেক্ষিক তাপ আসলে কী, সেই বিষয়ে আমরা কিছুই বলিনি। আপেক্ষিক তাপ মানে হলো একটি পদার্থের এক ইউনিট ভরের তাপমাত্রা এক ইউনিট বাড়াতে যে পরিমাণ শক্তি বা তাপ বাইরে থেকে জোগানোর দরকার হয়। তরল হিলিয়ামের আপেক্ষিক তাপের মান অন্যান্য পদার্থের তুলনায় বেশি। উদাহরণ হিসেবে ১.৫ কেলভিন তাপমাত্রায় ১ গ্রাম হিলিয়াম-৪ এর আপেক্ষিক তাপ ১ জুল/কেলিভন, অথচ ওই একই তাপমাত্রায় ১ গ্রাম কপারের আপেক্ষিক তাপ মাত্র ১০-৫ জুল/কেলভিন। হিলিয়ামের এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র যে নিম্ন তাপমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব তাই নয়, এরই সঙ্গে অন্যান্য পদার্থের বিভিন্ন ধর্মকে পরীক্ষার মাধ্যমে জানতেও অনেক সুবিধা হয়। ঘটনা হলো হিলিয়ামের-৪ এর আপেক্ষিক তাপ পরিমাপ করলে, এবং তাকে তাপমাত্রার ফাংশন হিসেবে আঁকলে ২.১৭ কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রাতে একটি শিখর (পিক) দেখা যায়। ওনেস প্রথম যখন এই শিখরটি দেখেন তখন একে তিনি পরীক্ষার একটি গাফিলতি হিসেবেই মনে করেছিলেন, তাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেননি। অবশ্য এর কিছু সময় পরেই এটা জানা যায়, রেখাচিত্রের শিখরের কারণ আসলে ২.২ কেলভিন তাপমাত্রার নীচে হিলিয়াম-৪ এর দশার পরিবর্তন, যাকে বলা হয় ফেস-ট্রানসিশন, এবং যে তাপমাত্রায় এই ঘটনাটি ঘটে, সেই তাপমাত্রাকে বলা হয় ল্যামডা-পয়েন্ট। এরকম বলার কারণ এই রেখাচিত্রের দশার পরিবর্তনের অঞ্চলটি দেখতে অনেকটা গ্রীক লেটার ল্যামডার মতো।
২.১৭ কেলভিনের উপরের দশাকে বলা হয় হিলিয়াম-১ এবং ২.১৭ কেলভিনের নীচের দশাকে বলা হয় হিলিয়াম-২। এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন ওনেস হিলিয়াম-৪ এর দশার পরিবর্তনের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেননি! তার উত্তরে বলা যেতে পারে ১৯১১ সালে অতিপরিবাহী দশা আবিষ্কারের পরে, তিনি অতিপরিবাহীর বিভিন্ন ধর্ম জানতে এবং বুঝতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, আর অন্য কোনো প্রভাবের দিকে তিনি মনোনিবেশ করতে চাননি।
হিলিয়াম-৪ এর দশার পরিবর্তন ২.১৭ কেলভিনে নিশ্চিত একটি আকর্ষণীয় বিষয়। তা সত্ত্বেও এই পর্যবেক্ষণ বিরাট কিছু বিস্ময়কর ছিল না। কিন্তু চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ এবং এরই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছিল ২.১৭ কেলভিন তাপমাত্রার নীচে, অর্থাৎ কিনা সেই হিলিয়াম-২ দশা আসলে সুপারফ্লুইড বা অতিতরল। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি করেন পিওট্র কাপিতসা রাশিয়ার মস্কোতে এবং জন এফ এলেন, ডন মিসেনের টরোন্টোতে। এঁরা আলাদা ভাবেই এই আবিষ্কারটি করেন। তাঁদের আবিষ্কার নিয়ে প্রবন্ধ নেচার পত্রিকায় পৃথকভাবেই প্রকাশিত হয়।
কাপিতসা জীবনের প্রথমদিকে চুম্বকক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ শুরু করলেও, পরবর্তীকালে নিম্ন-তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। হিলিয়াম-৪ এর বিভিন্ন ধর্ম পরীক্ষার সময় পরিমাপকালে, মূলত হিলিয়াম-৪ এর থার্মাল কন্ডাকটিভিটি বা তাপ পরিবাহিতা মাপজোকের সময়ে, কাপিতসা পরিমাপ করেন হিলিয়াম-৪ এর প্রবাহ দুটি গোলাকার চাকতির মাঝে যেখানে সামান্য পরিমাণে সমভাবে শূন্যস্থান রাখা, এই পুরো সিস্টেমকে আবার হিলিয়াম-৪ পাত্রে ডোবানো আছে, সেইক্ষেত্রে হিলিয়ামের-৪ এর প্রবাহ বেশ চিত্তাকর্ষক। ল্যামডা বিন্দুর উপরে গোলাকার চাকতির মধ্য দিয়ে হিলিয়াম প্রবাহ খুবই কম, কিন্তু ল্যামডা বিন্দুর ঠিক নীচে হিলিয়াম প্রবাহের গতি অনেক বেড়ে যায়, এবং তা এতটাই বেড়ে যায় যে কাপিতসা সেই ঘটনাকে অতিপরিবাহীর সঙ্গে তুলনা করে বলেন হিলিয়াম-৪ ল্যামডা বিন্দুর নীচে একটি নতুন দশায় চলে যায়, এবং একে বলা যায় সুপারফ্লুইড (অতিতরল)।
এ গেল কাপিতসার পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কারের কথা, অন্যদিকে মিসেনার হিলিয়াম নিয়ে পরীক্ষাটি কিছুটা অন্যরকমভাবেই পরিচালনা করেন। তিনি যে পরীক্ষাটি করেন তাতে একটি সরু কাঁচের টিউবের মধ্যে দিয়ে হিলিয়াম প্রবাহিত হয় খুবই কম সান্দ্রতায়। শুধু তাই নয়, তরল হিলিয়ামের প্রবাহ চাপের উপরও খুব একটা নির্ভর করে না। প্রথমদিকে হিলিয়ামের এই অতিতরল দশাকে টু-ফ্লুইড মডেলের সাহায্যে বর্ণনা করার চেষ্টা চলেছিল। মানে তরল হিলিয়াম-৪ এর অতিতরল দশায় তরল হিলিয়ামকে দুটি অংশে ভাগ করা যায়–একটি অংশ অতিতরল এবং বাকি অংশটি সাধারণ তরল। এই মডেলের মূল ধারণাটি হল একইরকম। তাপমাত্রা কমানোর সঙ্গে অতিতরল দশাতে অতিতরল অংশটির অনুপাত একটু করে বাড়তে থাকে, আর অন্যদিকে সাধারণ তরলের অনুপাতটি কমতে থাকে। এবং অতিতরল দশার খুব গভীরে অতিতরল অংশের অনুপাতটিই প্রাধান্য পায়, আর সাধারণ তরলের অনুপাতটি মূলত শূন্য হয়। অতিতরল দশা আবিষ্কার হবার প্রায় তিন দশক পরে কাপিতসা তাঁর সেই অনবদ্য আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। আলেন এবং মিসেনের যদিও প্রায় একই সময়ে অতিতরল দশা আবিষ্কার করেছিলেন, তবুও অতিতরল দশার আবিষ্কারক হিসেবে কাপিতসার নামই বেশি শোনা যায়, এবং অতিতরল দশার আবিষ্কারক হিসেবে তাঁকেই সাধারণত স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কাপিতসার অতিতরল দশা নিয়ে পরীক্ষার যন্ত্রের একটি সরল চিত্র.
উপরের ছবিতে দেখানো হয়েছে অতিতরল দশা প্রমাণের জন্যে পরীক্ষার একটি সরল চিত্র। লাল তীরটি নির্দেশ করছে প্রবাহিত তরল হিলিয়ামের দিক দুটো গোলাকার চাকতির মধ্য দিয়ে। গোলাকার চাকতি দুটোর মধ্যে দূরত্ব বাড়ানো এবং কমানো যায় একটি সুতোর সাহায্যে (৪)। তরল হিলিয়াম এখানে যে গোলাকার টিউবের মধ্যে আছে তা হিলিয়ামের মূল পাত্রের (৫) থেকে যেন উপরে থাকে, চিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে।
২.১৭ কেলভিন তাপমাত্রার উপরে টিউবের হিলিয়ামের উচ্চতা এবং পাত্রের হিলিয়ামের উচ্চতার মধ্যে পার্থক্য অল্পসময়ের জন্যে বজায় থাকে, কয়েক মিনিটের মতো। কিন্তু ২.১৭ কেলভিন তাপমাত্রার নীচে, মানে ক্রিটিক্যাল পয়েন্টের নীচে তরল হিলিয়াম প্রবাহিত হয় খুব সহজে। অতি শীঘ্রই, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুই স্থানের হিলিয়ামের মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য কমে সমান হয়ে যায়। এই পরীক্ষা থেকে কাপিতসা গণনা করেন তরল হিলিয়ামের সান্দ্রতা অতিতরল দশায় স্বাভাবিক চাপে অন্তত ১৫০০ গুণ কম, এবং কাপিতসা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ২.১৭ কেলভিন তাপমাত্রার নীচে তরল হিলিয়ামের সান্দ্রতা এতটাই কমে যায় যে তাকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তিনি অতিপরিবাহীর সঙ্গে তরল হিলিয়ামের এই বিশেষ দশার কথা তুলনা করে এর নামাকরণ করেন সুপারফ্লুইড, আর আমরা বাংলায় বলতে পারি অতিতরল। কাপিতসা যদিও তাঁর মূল প্রবন্ধ, যা নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর এই আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে, তাতে তিনি সুপারকন্ডাক্টরকে সুপরাকন্ডাক্টর বলেছিলেন। ১৯১১ সালে অতিপরিবাহী দশা আবিষ্কৃত হলেও, সেই দশার বর্ণনার জন্যে যুক্তিযুক্ত, সবচেয়ে প্রচলিত আণুবীক্ষণিক বা মাইক্রোস্কোপিক তত্ত্ব আসে সেই ১৯৫৭ সালে। যাকে আমরা বি সি এস তত্ত্ব বলেই জানি। বি সি এস তত্ত্ব আসার পরে অতিপরিবাহী এবং অতিতরলের মধ্যে যে একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে তাও অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। অতিতরলকে বোঝার জন্যে প্রথম যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা আসে ফ্রিটজ লন্ডনের কাছ থেকে। বর্তমানে আমরা দুই ধরনের অতিতরলের কথা বলতে পারি। প্রথমটি তরল হিলিয়াম, যেখানে এই দশা দেখা যায় এবং দ্বিতীয়টি অতিপরিবাহী যেখানে ইলেকট্রনগুলো জোট বেঁধে এই অতিতরল দশার মতো আচরণ করে।
আসল নেচার পত্রিকা থেকে এই ছবিটি নেওয়া। একটি গোলাকার অংশ ছবিতে যোগ করা হয়েছে এটা দেখাতে প্রথমে কী করে সুপারলিক তৈরি করেছিলেনআলেন এবং জোনস তাঁদের পরীক্ষাটিসম্পন্নকরবার জন্যে।
ফাউন্টেন এফেক্ট শূন্য সান্দ্রতা ছাড়াও তরল হিলিয়ামের আরও বিশেষ কিছু ধর্ম আছে, যা ক্লাসিক্যাল তরলে, যেমন জল তেল রস, কখনই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফাউন্টেন ক্রিয়া। উপরের ছবিতে হিলিয়ামের ফাউন্টেন ক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্যে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। খুব সরু ক্যাপিলারি টিউব বা কৈশিকী নল এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়। ক্যাপিলারি টিউবের একটা দিক তরল হিলিয়ামের মধ্যে ডোবানো এবং অন্য দিকটি তরল হিলিয়ামের উপরিতল থেকে কয়েক সেন্টিমিটার উপরে রাখা। ক্যাপিলারি টিউবের যে-দিকটি তরল হিলিয়ামে ডোবানো তার শেষ প্রান্ত ঠাসা আছে এমারি গুঁড়ো দিয়ে। সুপারলিক বা খুব সূক্ষ্ম ছিদ্র তৈরির জন্যেই এটা করা হয়। এই ব্যবস্থাতে যেসব তরলের সান্দ্রতা খুব বেশি তারা ওই এমারি গুঁড়োর মধ্যে দিয়ে কিছুতেই প্রবাহিত হতে পারবে না। কিন্তু তরল হিলিয়াম সহজেই ওই সুপারলিকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে সক্ষম। টিউবের অন্য প্রান্তটি মূল হিলিয়াম পাত্রের কয়েক সেন্টিমিটার উপরে রাখা। পরবর্তী কাজ হলো টিউবের নীচের অংশে যে এমারি গুঁড়ো আছে একটি ইলেকট্রিক পকেট টর্চ দিয়ে তাকে আলোকিত করা। ফলত তরল হিলিয়াম নিয়মিতভাবে ওই ক্যাপিলারি টিউবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে, এবং একটি ফাউন্টেনের বা ফোয়ারার মতো ক্রমাগত তরল হিলিয়াম টিউবের অন্য প্রান্ত থেকে নির্গত হয় যতক্ষণ অবধি ওই সুপারলিক তৈরির জন্যে গুঁড়োকে আলোকিত করা হয়।
তরল হিলিয়ামের উপর বিভিন্ন রকমের গবেষণা চালালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনেক প্রভাব জানা সম্ভব হয়। বিশ্বের সমস্ত আবিষ্কৃত পদার্থই তাপমাত্রা কমানোর ফলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পৌঁছলে–তাপমাত্রা যদিও বিভিন্ন পদার্থের ক্ষেত্রে বিভিন্ন–এমনকি স্বাভাবিক চাপেও কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। মূল কথা হলো তাপমাত্রা কমালে পদার্থের অণু অথবা পরমাণুর গতিশক্তি শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে। সেই কারণে অণু-পরমাণুগুলো তাদের ল্যাটিসে আবদ্ধ থাকে। তাপমাত্রা যত কমানো হয় গতিশক্তি ততই কমে, এবং একেবারে শূন্য তাপমাত্রায় অণু-পরমাণুগুলো, ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী স্থির হয়ে যায় বটে, তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী সেই অণু-পরমাণুগুলোর পরম-শূন্য তাপমাত্রাতেও অস্থিরতা থাকে। একে আমরা বলে থাকি জিরো-পয়েন্ট এনার্জি (বাংলায় বলা যায় শূন্য-বিন্দুর শক্তি)। জিরো-পয়েন্ট এনার্জি হলো যে-কোনো পদার্থের সর্বনিম্ন শক্তি। কোনো পদার্থের শক্তি এর থেকে কম হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হিলিয়ামের ক্ষেত্রে এই জিরো-পয়েন্ট এনার্জি এতটাই বেশি থাকে যে হিলিয়াম পরমাণুগুলোকে স্বাভাবিক চাপে তার ল্যাটিসে আবদ্ধ রাখা সম্ভবপর নয় যাতে করে হিলিয়াম তরল থেকে কঠিন পদার্থে পরিণত হবে। শুধুমাত্র বাইরে থেকে যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করলে হিলিয়াম কঠিন পদার্থে পরিণত হয়। মজার ঘটনা হলো, হাইড্রোজেন পরমাণু যদিও হিলিয়ামের থেকে হালকা তবুও হাইড্রোজেন পরমাণুগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তী আকর্ষণবল এতটাই প্রবল থাকে যে, হাইড্রোজেন নিম্ন-তাপমাত্রায় কঠিন পদার্থে পরিণত হয়।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়ম বলে একই ধরনের ক্ষুদ্র কণা প্রভেদশূন্য বা ইনডিসটিংগুইসেবেল। দুই ধরনের ক্ষুদ্র কণার কথা আমরা জানি, তারা ফারমিয়ন্ এবং বোসন এই দুইভাগে বিভক্ত। আবার ফারমিয়নগুলো মিলে তৈরি করতে পারে সংযুক্ত বোসন। যেমন একটি হিলিয়াম-৪ অণুকে বলা যায় একটি সংযুক্ত বোসন। একটি হিলিয়াম-৪ অণুতে আছে দুটি প্রোটন, দুটি নিউট্রন এবং দুটি ইলেকট্রন। খুব নিম্ন-তাপমাত্রায় হিলিয়াম তরলের বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেশন ঘটে, এবং হিলিয়াম-৪ অতিতরল দশায় চলে যায়। ঠিক একইভাবে অতিপরিবাহীতে দুটি ইলেকট্রন ফোনোনের মাধ্যমে একসঙ্গে জোট বেঁধে তৈরি করে সংযুক্ত বোসন, যাকে বলা হয় কুপার পেয়ার, এবং যা কন্ডেন্সেট বা ঘনীভূত হয়ে তৈরি করে অতিপরিবাহী। তাই অতিপরিবাহীও হলো একটি অতিতরল দশা। অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে সংযুক্ত বোসন কোনোরকম বাধা ছাড়াই পদার্থের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে, ঠিক যেমন অতিতরল দশায় তরল হিলিয়াম বিন্দুমাত্র বাধা ছাড়াই চলাফেরা করতে পারে। প্রথমটির ক্ষেত্রে পরিমাপ করা যায় রোধের মাধ্যমে, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে আমরা পরিমাপ করি সান্দ্রতার মাধ্যমে।
আর কোথায় দেখা যায় অতিতরল দশা এই অবধি আমরা আলোচনা করেছি তরল হিলিয়াম-৪ এর অতিতরল দশা নিয়ে। কিন্তু শুধুমাত্র তরল হিলিয়াম-৪ নয়, এরই সঙ্গে, হিলিয়ামের আরেকটি আইসোটোপ হিলিয়াম-৩-এও এই অতিতরল দশার ধর্মগুলো দেখা যায়। হিলিয়াম-৩ যে হিলিয়ামেরই আইসোটোপ, এই প্রস্তাবটি প্রথম করেন অস্ট্রেলিয়ান পদার্থবিদ মার্ক অলিফান্ট ১৯৩৪ সালে। অলিফান্ট একটি পরীক্ষা করেন যাতে অতি দ্রুতগতি-সম্পন্ন ডয়টেরনের সংঘর্ষ ঘটে ডয়টেরন টার্গেটের সঙ্গে। এর কিছুকাল পরে ১৯৩৯ সালে লুইস আলভারেজ এবং রবার্ট করনগ প্রথম সফলতার সঙ্গে হিলিয়াম-৩ পরীক্ষাগারে তৈরি করেন। প্রথমদিকে হিলিয়াম-৩ কে মনে করা হতো একটি রেডিওঅ্যাক্টিটিভ বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ। পরবর্তীকালে অবশ্য জানা যায় হিলিয়াম-৩ প্রাকৃতিক অবস্থায় প্রাপ্ত হিলিয়াম গ্যাস থেকেও পাওয়া যায় এবং এটি কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ নয়। ইদানীংকালে হিলিয়াম-৩ এর জোগান বিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার জন্যে খুব-একটা সুলভ নয়। এর মূল কারণ এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান পদার্থ এবং পরিবেশে এর অস্তিত্ব খুবই কম পরিমাণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সময় হিলিয়াম-৩ গ্যাস যথেষ্ট পরিমাণে বিজ্ঞানীদের হাতে আসে।
এবারে একটু জানা যাক কী করে এই হিলিয়াম-৩ পরীক্ষাগারে তৈরি করা সম্ভব। ট্রিটিয়াম হলো হাইড্রোজেনের একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। ট্রিটিয়াম সাধারণত তৈরি করা হয় লিথিয়াম-৬ কে নিউট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটিয়ে, একটি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে। লিথিয়ামের নিউক্লিয়াস একটি নিউট্রনকে গ্রহণ করে এবং দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তারা, যথাক্রমে হিলিয়াম-৪ এবং ট্রিটিয়াম। সেই ট্রিটিয়াম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে রূপান্তরিত হয় হিলিয়াম-৩ এ, আর ট্রিটিয়ামের হাফ-লাইফ বা অর্ধ-জীবনকাল ১২.৩ বছর। মোদ্দা কথা, হিলিয়াম-৩ উৎপাদন করা সম্ভব ট্রিটিয়ামকে বেশ কিছু বছর সঞ্চয় করে রাখলে, ঠিক যতদিনে ট্রিটিয়াম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে হিলিয়াম-৩ এ পরিণত না হয়। হিলিয়াম-৪ এর মতো হিলিয়াম-৩ কিন্তু কোনো কম্পসিট বোসন বা একাধিক কণা জুড়ে তৈরি হওয়া বোসন নয়। হিলিয়াম-৪ এর ক্ষেত্রে আছে জোড় ফারমিয়ন। হিলিয়াম-৩ এর ক্ষেত্রে আছে বিজোড় ফারমিয়ন। সেগুলো হলো দুটি প্রোটন, একটি নিউট্রন এবং দুটি ইলেকট্রন। সেই কারণে প্রথমে ধরা হয়েছিল, হিলিয়াম-৩ এ বোস-আইনস্টাইন কনডেন্সেট হওয়া সম্ভব নয়, এবং হিলিয়াম-৩ কোনো তাপমাত্রাতেই অতিতরলে পরিণত করা যাবে না। বাস্তব অবশ্য কিছুটা অন্যরকমেরই, অর্থাৎ পরীক্ষালব্ধ ফল কিছুটা অন্যরকমেরই। এ ছাড়াও বি সি এস তত্ত্ব তৈরি হবার পরে, আর-একটি ধারণাও সকলের মনে দানা বাঁধছিল, তা ছিল কম্পসিট বোসন দিয়ে তৈরি হওয়া কুপার পেয়ার নিয়ে। সেই কুপার পেয়ার আসলে কনডেন্স বা ঘনীভুত হয়ে তৈরি হতে পারে এমন একটি অতিতরল। গত শতাব্দীতে বেশকিছু মৌলধর্ম প্রকল্পিত অতিতরলের উপর ভিত্তি করে তাত্ত্বিকভাবে গণনা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, সেই তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর মধ্যে কিছু ধারণা আবার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিতও হয়। অবশেষে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই হিলিয়াম-৩ এ অতিতরল দশা আবিষ্কৃত হয় ০.০০৩ কেলভিনের নীচে। সেই পর্যবেক্ষণের পরে, প্রাথমিকস্তরে এটাই ভাবা হয়েছিল হিলিয়াম-৩ কঠিনে পরিণত হয়ে, হিলিয়াম-৩ এর নিউক্লিয়াসের স্বতঃস্ফূর্ত ম্যাগনেটিক অর্ডার বা বিন্যাসের জন্যেই এইরকম কিছু-একটা ঘটছে। এর কিছুকাল পরে আরও কিছু ধর্ম যাচাই করে এটা নিশ্চিত হয় যে হিলিয়াম-৩ বাস্তবেই অতিতরল দশায় চলে যায় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নীচে। হিলিয়াম-৩ পরমাণুর ক্ষেত্রে ০.০০১ কেলভিনের নীচে নিউক্লিয়াসের স্বতঃস্ফূর্ত ম্যাগনেটিক অর্ডার বা বিন্যাস ঘটে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে হিলিয়াম-৩ এ অতিতরল দশা আবিষ্কার হলো বটে, তবে তাত্ত্বিকভাবে হিলিয়াম-৩ এর অতিতরল দশাকে ব্যাখ্যা করা একেবারেই সহজ হলো না। হিলিয়াম-৩ পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে আকর্ষণ অত্যন্ত জটিল, এবং যেভাবে ইলেকট্রনগুলো জোট বাঁধে তাও অত্যন্ত জটিল। পুরো বিষয়টিই হলো এক বিরাট ধাঁধাঁর। মোদ্দা কথা, ফারমিয়নদের ক্ষেত্রে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত দশায় আসতে হলে ফারমিয়নগুলোকে জোট বেঁধে তৈরি করতে হবে বোসন কণা। ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই জোট বাঁধা কিছুটা হলেও সহজ। ইলেকট্রনের যে ওয়েভ-ফাংশন তার যে প্রতিসম বিন্যাস থাকে, তাকে বলা হয় এস-ওয়েভ। কিন্তু হিলিয়াম-৩ পরমাণু বহন করে একটি জটিল জোট, এবং সেটি পি-ওয়েভ জোট। তাই অরবিটাল কৌণিক ভরবেগ হিলিয়াম-৩ পরমাণুর ক্ষেত্রে শূন্য থাকে না। হিলিয়াম-৩ পরমাণুর ক্ষেত্রে এই অরবিটাল কৌণিক ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ভেক্টর রাশি বলতে এমন একটি অবজেক্ট, যার মান এবং দিক দুই-ই আছে। আবার ভেক্টরকে একটু অন্যভাবে দেখলে বলা যেতে পারে এটি রৈখিকভাবে সরানোর প্রতিসাম্য বজায় রাখে। এরই সঙ্গে হিলিয়াম-৩ পরমাণুর আছে স্পিন। এই স্পিনের মানও আবার শূন্য নয়। এই স্পিন হলো অন্য আর-একটি ভেক্টর। তাহলে যেটা দাঁড়াল, হিলিয়াম-৩ পরমাণুর ক্ষেত্রে একটি ভেক্টর কৌণিক ভরবেগের জন্যে এবং আর-একটি ভেক্টর স্পিনের জন্যে। সাকূল্যে হিলিয়াম-৩ এর ক্ষেত্রে যে কুপার-জোট গঠিত হয়, তাদের থাকছে দুই রকমের কৌণিক ভরবেগ। এদের চিহ্নিত করা হয় অরবিটাল কোয়ান্টাম নাম্বার (L) এবং স্পিন কোয়ান্টাম নাম্বার (S) দিয়ে। প্রথাগত অতিপরিবাহীতে, অর্থাৎ কনভেনশনাল বি সি এস অতিপরিবাহীতে L=0 এবং S=0 হয়, কিন্তু অতিতরল হিলিয়ামের-৩ এর ক্ষেত্রে L=1 এবং S=1 হয়। অতিতরল দশাকে বোঝা সম্ভব, যদি বি সি এস তত্ত্বকে সামান্য কিছু পরিবর্তন করা হয়, এবং কিছু সংযোজন করা হয়। হিলিয়াম-৩ এ এই অতিতরল দশার আবিষ্কার শুধুমাত্র মৌলিক গবেষণার বিচারে মূল্যবান নয়।
এরই সঙ্গে এই আবিষ্কার আনকনভেনশনাল অতিপরিবাহীরও জন্ম দিয়েছিল। হিলিয়াম-৩ এর অতিতরল দশা আবিষ্কারের পরে বেশকিছু আনকনভেনশনাল অতিপরিবাহীরও আবিষ্কার সম্ভব হয়। এর মধ্যে অন্যতম হেভি-ফারমিয়ন সুপারকন্ডাক্টর, যা আবিষ্কৃত হয় ১৯৭৯ সালে। সেরিয়াম কপার টু সিলিকন টু CeCu2Si2 একটি ধাতব পদার্থ যেখানে আবিষ্কার হয় এই অতিপরিবাহিতা। প্রথাগত অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে অতিপরিবাহিতার মূল কারণ ইলেকট্রন এবং ফোনোনের মধ্যে যে ইন্টার্যাকশন তার জন্যে, কিন্তু CeCu2Si2 এর ক্ষেত্রে অতিপরিবাহিতা নির্ভর করে ইলেকট্রন এবং ইলেকট্রনের মধ্যে যে ইন্টার্যাকশন তার উপরে ভিত্তি করে। শুধু তাই নয়, CeCu2Si2 নিম্ন-তাপমাত্রাতে আবার নিজেই একটি চুম্বক। CeCu2Si2 তে অতিপরিবাহিতা আবিষ্কারের আগে এই ধারণাই ছিল যে, অতিপরিবাহিতা এবং চৌম্বকত্ব একে অন্যের বিরোধী, একের সঙ্গে অন্যের সহবস্থান সম্ভব নয়। চৌম্বকত্বের উপস্থিতি মানেই অতিপরিবাহিতার জন্যে তা হানিকর। সেই কারণেই তো প্রথাগত অতিপরিবাহীর মধ্যে চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হলে একটি নির্দিষ্ট মানের চৌম্বকক্ষেত্রের উপরে সেই পদার্থের অতিপরিবাহিতা নষ্ট হয়ে যায়। হেভি-ফারমিয়ন সুপার কন্ডাকটিভিটি আবিষ্কারের পরে বিজ্ঞানীমহলে এই সাড়া পড়েছিল যে, এমন পদার্থেও অতিপরিবাহিতার ধর্ম দেখা যেতে পারে যেখানে আয়তন (বাল্ক) চুম্বকত্ব উপস্থিত আছে।
হিলিয়াম-৩ এর অতিতরল দশাকে আবার অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মূলত সাধারণ তরল থেকে অতিতরল দশায় পৌঁছনো মানে এক ধরনের প্রতিসাম্যতা ভেঙে যাওয়া। জল থেকে বরফের দশার পরিবর্তন, অথবা সাধারণ পরিবাহী থেকে অতিপরিবাহী দশার পরিবর্তন, অথবা সাধারণ চুম্বক থেকে ফেরম্যাগনেট দশার পরিবর্তন, এই সব ক্ষেত্রেই প্রতিসাম্য ভেঙে যাবার যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু কী এই প্রতিসাম্য এবং কাকেই-বা বলে এই প্রতিসাম্যের ভেঙে যাওয়া, এই বিষয়ে এখনও আমরা কোনো ধারণা তৈরি করিনি। অথচ পদার্থবিদ্যার, মূলত পদার্থের কঠিন দশার বিভিন্ন বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে হলে এই প্রতিসাম্যের বিভিন্ন নিয়মনীতির সাহায্য নিলে গণনায় এবং ব্যাখ্যা করতে অনেক সুবিধা হয়।