গল্পের খাতিরে ধরে নেওয়া হোক হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়াতে পৌঁছতে চাই। এই যাত্রাপথটি অনেকটাই নির্ভর করবে রাস্তার বিভিন্ন বাধার উপর। রাস্তায় কত গাড়ি আছে, রাস্তায় ক’টা সিগন্যাল আছে, রাস্তায় ক’টা মিছিল আছে, রাস্তায় ক’টা বাস আছে, তাদের গতি, সেইগুলি রাস্তায় কতবার দাঁড়াচ্ছে যাত্রী তোলার তাগিদে, রাস্তায় কত মানুষ আছেন, রাস্তায় ক’টা গর্ত গাড্ডা আছে, আরও এই রকম অনেককিছু। এইগুলি সবই এক একটি রোধ বা বাধা সেই ছোট্ট যাত্রাপথে। দিনের বেলা এইসমস্ত বাধাগুলি অনেক বেশি থাকে, কিন্তু রাতের বেলায় পথঘাট সব ফাঁকা হয়ে যায়। তাই সেই একই পথ অতিক্রম করতে রাতের থেকে দিনের বেলায় সময় লাগে অনেক বেশি। কারণ দিনের বেলায় রোধ অনেক বেশি মজুত থাকে। মোদ্দা কথা রোধ অথবা বাধা-বিহীন জীবন হলে ভালোই হত আমাদের চলার পথে।
রোধ আসলে কী! প্রতিটি বাড়িতে যে কারেন্ট তামার তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা ইলেকট্রনের প্রবাহ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই কারেন্ট থেকেই আমাদের ঘরে আলো জ্বলে, আমাদের টেলিভিশন চলে, আমাদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, হিমায়ক ইত্যাদি সবই চলে। তার মানে প্রবাহিত ওই ইলেকট্রনই এই সবকিছুর জন্যে দায়ী। সহজ কথায় আমরা বলতে পারি, কারেন্ট অর্থাৎ ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া আমাদের জীবন একেবারেই অচল। কিন্তু কথা হল, এই যে ইলেকট্রন তামা, অ্যালুমিনিয়াম, বা সোনা এইসব ধাতুর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, তা কি বিনা বাধায়, বা বিনা রোধে। উত্তর হল: একেবারেই নয়। যে ধাতুর মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন যত সহজে প্রবাহিত হতে পারে তাকেই বলা হয় তত সুপরিবাহী। সেই কারণেই তামা, সোনা এইগুলি হলো সুপরিবাহী পদার্থ। কারেন্ট প্রবাহের জন্যে ব্যবহৃত তার প্রস্তুত করতে এইগুলি বেশি কাজে লাগে। যদিও বাড়িতে, অফিসে, কর্মস্থলে, কারখানায় আমরা শুধু তামার তারই দেখি, সোনার তার নয়, এর একমাত্র কারণ তামা শস্তায় এবং সহজে পাওয়া যায়। আগে অবশ্য অ্যালুমিনিয়ামও ব্যবহার করা হত। ওজনের ভিত্তিতে তামার সাথে তুলনা করলে অ্যলুমিনিয়াম আরও সুপরিবাহী। কিন্তু অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করার অসুবিধা হল, উত্তাপে অ্যালুমিনিয়ামের সম্প্রসারণ বেশি হয়। এ ছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড যা রাস্ট পড়লে, তখন আর অ্যালুমিনিয়াম তেমন কারেন্টের সুপরিবাহী থাকে না। তামার ক্ষেত্রে সেই ঝামেলা কম। যেসমস্ত পদার্থে ইলেকট্রন এক জায়গায় বদ্ধ থাকে, অর্থাৎ সহজে প্রবাহিত হয় না, সেগুলিকে আবার বলা হয় অপরিবাহী বা কুপরিবাহী। অধিকাংশ প্লাস্টিক, রাবারই হল অপরিবাহী। সেই কারণেই বাড়িতে আমরা যে কারেন্ট প্রবাহের তার দেখি সেই তারের আবরণটি থাকে এইরকমেরই কোনো অপরিবাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি, যাতে করে সেই তার ধরলেও তড়িৎ-প্রবাহের সাহায্যে আমাদের প্রাণনাশের সম্ভাবনা না থাকে। এই অপরিবাহী এবং সুপরিবাহীর মাঝেও একধরনের পদার্থ আছে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী। অর্ধপরিবাহী যদিও প্রাথমিকভাবে অপরিবাহীর মতনই আচরণ করে, তবে এই অর্ধপরিবাহী পদার্থের মধ্যে পরিমাণগত অপদ্রব্য মেশানো হলে তা আবার সুপরিবাহীর মতনই আচরণ করে। জার্মেনিয়াম, সিলিকন এইসব হল অর্ধপরিবাহীর উদাহরণ। বর্তমানে অর্ধপরিবাহীর ব্যবহার প্রচুর। বলা যায় এর অভাবে আমাদের আধুনিক জীবন প্রায় অচল হয়ে যাবে। কারণ টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার এইসব ছাড়া কেউ কি একদিনও থাকার কথা ভাবতে পারেন! ট্রানজিস্টার, বিভিন্ন মানের ও মাপের চিপ, আধুনিককালে যা প্রযুক্তির একটি বড় কাঠামো, সেইসমস্ত পদার্থ এই অর্ধপরিবাহীর সাহায্যেই প্রস্তুত করা হয়। আমাদের হাতে যে স্মার্ট অথবা মোবাইল ফোনটি থাকে, অথবা কম্পিউটার, বা ল্যাপটপ, টেলিভিশন, এ ছাড়াও অধিকাংশ ইলেকট্রনিক দ্রব্যের মধ্যে ইলেকট্রনিক সার্কিটের একটি মূল অংশ এই অর্ধপরিবাহী দিয়েই তৈরি।
অতিপরিবাহী (সুপারকন্ডাক্টর) কিন্তু এই সবকিছুর থেকে একেবারে আলাদা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অতিপরিবাহী পদার্থের এমন কিছু ধর্ম যেখানে ইলেকট্রন এদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় কোনোরকম বাধা বা রোধ ছাড়াই। শুনতে অবাক লাগছে না! একেবারে বাধাহীন জীবন, একেবারে বাধাহীন প্রবাহ। কেমন ঘটনাটা! ধরে নেওয়া যাক, একটি ব্যাটারির তার সংযোগে একটি বিজলিবাতি জ্বালানো হল। আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি কী বলে? এই বিজলিবাতি কি অনন্তকাল ধরে আলো দিয়ে যাবে? অবশ্যই নয়। যতক্ষণ ব্যাটারি বিজলিবাতির জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করতে সমর্থ থাকবে, মানে কারেন্ট পাঠাতে পারবে, ততক্ষণই আলো জ্বলবে। এবার কল্পনার একটি পরীক্ষা চালনা করা হল, যাতে বিজলিবাতির আলোর জন্যে এমন একটি পদার্থ প্রয়োগ করা হল, যা রোধ-বিহীন, এবং কারেন্টের জন্যে যে তার তৈরি করা হল, তাও রোধ-বিহীন। তাহলে যা ঘটবে তা হল, একবার সেই তারের মধ্যে দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হলে, অনন্তকাল ধরে সেই কারেন্ট প্রবাহিত হতে থাকবে।
এইসব পড়ে কেমন যেন কল্পবিজ্ঞানের মতনই মনে হয়। কিন্তু আধুনিককালে এইরকম পরিবাহী তার বাস্তবেই আছে। হয়তো তা দিয়ে আলো জ্বলে না, কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, অনন্তকাল একবার কারেন্ট প্রবাহিত হলে, সেই কারেন্ট একই ভাবেই প্রবাহিত হতে থাকে। এই হল অতিপরিবাহীর একটি মূল ধারণা।
চিত্র: অতিপরিবাহীর একটি বিশেষ ধর্মের জন্যে, যাকে বলে মাইসনার এফেক্ট, অতিপরিবাহী পদার্থ বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যেতে পারে যদি একটি কম মাত্রার চুম্বককে ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। রোধশূন্য হওয়া মানেই কিন্তু অতিপরিবাহী, তা নয়, এরই সাথে মাইসনার ক্রিয়া এই ধর্মটি কোনো পদার্থ প্রদর্শন করলে তবেই তাকে বলা যাবে অতিপরিবাহী। তাই মাইসনার ক্রিয়া অতিপরিবাহিতার একটি অন্যতম ধর্ম।
তরল হিলিয়াম নিম্ন তাপমাত্রার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসলে খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে অতিপরিবাহিতার কথা। কোনোরকম তর্ক ছাড়াই বলা চলে নিম্ন তাপমাত্রার খোঁজই প্রাথমিকভাবে ঘটিয়ে ছিল অতিপরিবাহীর মতন পদার্থের এক নতুন অভিনব দশার আবিষ্কার। যদি-না হিলিয়াম গ্যাসের তরলীকরণ সম্ভব হত তাহলে অনুমান করা যায় এই বিষয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস কিছুটা অন্যরমকই হত, এই আবিষ্কার মানুষের হয়ত অধরাই থেকে যেত। এখন প্রশ্ন হল, কী এই অতিপরিবাহিতা? সহজ করে বললে অতিপরিবাহিতা পদার্থের এমন একটি দশা, যেখানে পদার্থের কোনো রোধ থাকে না, অর্থাৎ কারেন্ট বা বিদ্যুৎপ্রবাহ স্বচ্ছন্দে, বিনা বাধায় পদার্থের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পারে। এরই সাথে অতিপরিবাহী দশা ‘মাইসনার এফেক্ট’ নামে একটি ক্রিয়া প্রদর্শন করে। প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্রকে অতিপরিবাহী পদার্থের মধ্যে প্রবেশ করতে দেয় না, পরিবর্তে বিতাড়িত করে। একটি চুম্বকের ক্ষেত্রে যা ঘটে চুম্বকের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে লাইনস অফ ফোর্স বিস্তৃত থাকে। লাইনস অফ ফোর্সের বিস্তারের উপরই নির্ভর করবে সেই পদার্থের চুম্বকধর্ম, এবং সেই চুম্বক অন্য পদার্থকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। অতিপরিবাহী পদার্থকে চুম্বকের কাছে আনলে উচ্চ তাপমাত্রায় সাধারণ পরিবাহী দশায় খুব সহজেই চুম্বকের লাইনস অফ ফোর্সগুলি অতিপরিবাহী পদার্থের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু তাপমাত্রা কমালে পদার্থটি অতিপরিবাহী দশায় পৌঁছলে সেই লাইনস অফ ফোর্সগুলি যা অতিপরিবাহী পদার্থের মধ্যে সহজে প্রবেশ করেছিল, তা সেখান থেকে বিতাড়িত হয়। চুম্বকক্ষেত্র বিতাড়িত হয়, কারণ অতিপরিবাহীর ভূতলে কারেন্ট প্রবাহিত হয়, যাকে বলা হয় স্ক্রিনিং-কারেন্ট। একে স্ক্রিনিং-কারেন্ট বলার কারণ এই কারেন্ট অতিপরিবাহীর ভিতরকে আড়ালে করে রাখে প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্র থেকে। শুধু তাই নয় স্ক্রিনিং-কারেন্ট আবার একটি চুম্বকক্ষেত্র তৈরি করে সেই অতিপরিবাহীর বাইরে, যা বাধা দেয় প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্রকে।
এখনও অবধি অতিপরিবাহিতা একটি নিম্ন তাপমাত্রারই দশা, কক্ষ-তাপমাত্রায় এবং তারও বেশি তাপমাত্রায় এই ঘটনার এখনও উপস্থিতি প্রমাণিত হয়নি বা এমন কোনো পদার্থ আবিষ্কৃত হয়নি যা কক্ষ তাপমাত্রা বা তারও অধিক তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী ধর্ম প্রদর্শন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতেও পদার্থের এই বৈশিষ্ট্য মানুষের অজানা ছিল। কিন্তু হিলিয়াম গ্যাসের তরলীকরণ অথবা নিম্ন-তাপমাত্রার খোঁজই এনে দিল এই অনবদ্য সৃষ্টি। তবে একথা আজও সত্যি সর্বোচ্চ যে তাপমাত্রায় বেশকিছু পদার্থ এই ধর্মকে প্রদর্শন করে তা কিন্তু স্বাভাবিক কক্ষ-তাপমাত্রার এখনও অনেক নীচে। এর পরেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতিপরিবাহীর ধর্মকে কাজে লাগিয়ে যেমন তৈরি হয়েছে ‘ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং’-এর জন্যে প্রয়োজনীয় স্থিতিশীল, তীব্র, বড় আয়তনের ম্যাগনেট, যার অনেক প্রয়োগ হচ্ছে আজ চিকিৎসাক্ষেত্রে। প্রতিটি উন্নতমানের চিকিৎসাবিভাগে এই যন্ত্রটি উপস্থিত থাকে। এ ছাড়াও জাপানে এবং চীনে তৈরি করা হয়েছে ‘ম্যাগলেভ’ ট্রেন। আছে বিজ্ঞানের বিভিন্নক্ষেত্রে এর প্রয়োগ। আর সময়ের সাথে সাথে এর প্রয়োগ শুধু বেড়েই চলেছে।
অন্য কীভাবে ভাবা যায় অতিপরিবাহীকে আর একটু বুঝতে হলে কিছুটা এইভাবেও ভাবা যায়। যখন একটি তার কারেন্ট প্রবাহিত করে তখন সেই তারটি সময়ের সাথে সাথে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পদার্থের এই ধর্মকে বলা হয় ‘জুল-হিটিং’। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জেমস প্রেস্কট জুল, যিনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে জীবন শুরু করলেও, পরবর্তীকালে পদার্থবিদ হিসেবেই আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে আছেন, তিনিই ‘জুল-হিটিং’ নামে পদার্থের এই ধর্মটি আবিষ্কার করেন। যদিও কারেন্ট প্রবাহিত হবার কারণে উৎপাদিত তাপ খুব বেশি পরিমাণে হয় না। তবে কারেন্ট প্রবাহের মাত্রার উপর নির্ভর করে এই উৎপাদিত তাপের পরিমাণ। প্রতিটি ঘরে ঘরে যে সরু ‘ফিউজ’ তার লাগানো থাকে, তাতে অতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহিত হলে সেই ফিউজে তারটি অত্যধিক তাপমাত্রার জন্যে গলে যায় এবং বৈদ্যুতিক সার্কিটটি ছিন্ন হয়। ঘরের প্রতিটি তারই এইভাবে গলে যেত, যদি কোনো কারণে অতিরিক্ত কারেন্ট ওই তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত। যাতে এই ঘটনা এড়ানো যায়, সেইজন্যে প্রবাহিত কারেন্টের উপর নির্ভর করে তারের ব্যাসার্ধ ঠিক করা হয়। তবে ফিউজের তারটি অত্যন্ত সরু, এবং যে পদার্থ সেখানে ব্যবহৃত হয় তার গলনাঙ্ক যেন কম থাকে সেটা খেয়াল রাখা হয়। ঘটনা হল, তারের মধ্য দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হলে কেন সেই তারের তাপমাত্রা বাড়ে। এর একটি মূল কারণ হল তারের রোধ। অনেকগুলি ইলেকট্রন যখন পদার্থের (তারের) মধ্য দিয়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রবাহিত হয়, তখন ইলেকট্রনগুলি কিন্তু বিনা বাধায় প্রবাহিত হতে পারে না। তাদের মধ্যে অসংখ্য সংঘর্ষ ঘটে আর বিক্ষিপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়াতেই প্রবাহিত ইলেকট্রনগুলির যথেষ্ট শক্তিরও অপচয় হয় এবং সেই শক্তির একটি অংশ স্থানান্তরিত হয় পদার্থের অন্য অণু-পরমাণুর মধ্যে। এইরকম সংঘর্ষ বা ধাক্কার কারণেই আমাদের ইলেকট্রিক হিটারটি গরম হয়, শীতকালে গিজার চালু করলে স্নানের ঘরে জল গরম হয়, ঘরের বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিটি গরম হয়, রান্নাঘরের টোস্টারটি আমাদের রুটি গরম করে দেয়। শুধু কী তাই! প্রথম যখন বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন, তারের মধ্য দিয়ে যখন বিদ্যুৎ যায় তখন তারটা গরম হয়ে ওঠে। তখন বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, যদি আরও বেশি গরম করা যায়, তাহলে সেই গরম তার থেকে নিশ্চয়ই আলোও নির্গত হবে। বাস্তবে তাই ঘটেও। সেই পথ ধরেই সময়ের সাথে সাথে বিজলিবাতিও আবিষ্কৃত হয়। আর তার পিছনে ছিল এক দীর্ঘ ইতিহাস। সেই আলোচনায় আমরা এখানে যেতে চাই না। এতক্ষণ আমরা যা বললাম তা সবই উপকারের কথা। কিন্তু ইলেকট্রিক তার, যা দূর-দূরান্ত থেকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনস্থল থেকে, শহরে, গ্রামে, পাহাড়ে, জঙ্গলে আমাদের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ বহন করে নিয়ে আসে, তার অনেকটাই কিন্তু যাত্রাপথেই এই ‘জুল-হিটিং’-এর জন্যে অপচয় হয়ে যায়। সেই অপচয়ের পরিমাণ নেহাত কম নয়। তাই এই পরিমাণ বিদ্যুতের অপচয়, উৎপাদিত শক্তিরও অপচয়। এই অপচয় কি সত্যি মেনে নেওয়া যায়! কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো সমাধানও নেই। অন্যদিকে আবার আগামীদিনে কোনো উপায় আমাদের সামনে আসবে না, সেটাই-বা কী করে বলা যায়।
এখানেই সামান্য আশার আলো হয়তো আছে। সেই আশার আলো দেখায় অতিপরিবাহী। অতিপরিবাহী মানে হল সেই পদার্থ, যেখানে ‘জুল-হিটিং’-এর কোনো বালাই নেই। বৈদ্যুতিক তার যে দূর-দূরান্ত থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিবহণ করে নিয়ে আসে, তারগুলো যদি অতিপরিবাহী পদার্থ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় তাহলে শক্তি অপচয়ের এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। কোনো অতিপরিবাহকের মাধ্যমে বিন্দুমাত্র শক্তি অপচয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তা হবে মানবসভ্যতার এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়। কিন্তু সেই মাইলস্টোন থেকে এখনও আমরা অনেকটাই দূরে আছি।
চিত্র:একটি ম্যাগ-লেভ ট্রেনের নমুনা।
প্রথম আবির্ভাব ১৯১১ সালের এপ্রিল মাসে নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানী হাইকে কেমারলিং ওনেস নিজের পরীক্ষাগারে আবিস্কার করলেন পারদ ধাতুর রোধ ৪.১৯ কেলভিনের নিম্নে নিয়ে গেলে আচমকা কমে যায়, এবং তাপমাত্রা আরও কমালে রোধ একেবারে শূন্য হয়ে যায়। তিনি হিলিয়াম গ্যাসকে তরলীকরণে সফল হয়ে একের পর এক ধাতুর নিম্ন-তাপমাত্রায় রোধ পরিমাপে ব্যস্ত ছিলেন। এখানে প্রশ্ন আসে, এত বিভিন্ন ধরনের পদার্থের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, তিনি কেন পারদ নিয়ে এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন?
কেন পারদ! প্রসঙ্গত বলা যায় পারদ ধাতুর রোধ পরিমাপের প্রতি তাঁর একটু বেশিই আগ্রহ ছিল। কারণ, পারদ ধাতুকে অতীব বিশুদ্ধ অবস্থায় গবেষণাগারে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পাওয়া সম্ভব। এমনকী সোনার থেকেও বেশি বিশোধিত করা সম্ভব ছিল এই ধাতুকে কক্ষ-তাপমাত্রায়। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ধাতু নিয়ে নিম্ন তাপমাত্রায় সেই ধাতুর রোধ পরিমাপ করা। কেমারলিং ওনেস একটি বিশুদ্ধ ধাতুকে নিম্ন তাপমাত্রার রোধ পরিমাপের জন্য চাইছিলেন অন্য একটি কারণে। তাঁর ধারণা ছিল, পরম-শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছলে সমস্ত বিশুদ্ধ ধাতুর রোধ একেবারে শূন্য হবে এবং তাঁর সেই ধারণার ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জন্য আবশ্যক ছিল একটি সঠিক পরীক্ষার। সেই সময় পারদের থেকে এত বিশুদ্ধ ধাতুর জোগানে অসুবিধা ছিল। তাই পারদ নিয়ে তাঁর পরিকল্পিত পরীক্ষা চালনা করতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করলেন অতিপরিবাহিতা, পদার্থের অবাক করে দেওয়া এক ধর্ম এবং পদার্থের এক নতুন দশা।
চিত্র: ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং যন্ত্র। গোলাকার অংশটি একটি অত্যাধুনিক অতিপরিবাহী চুম্বক। চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগনির্ণয় করার জন্যে এর ব্যবহার আজ অনেক।
অবাক করে দেওয়া ঘটনা এই পর্যবেক্ষণে হাইকে কেমারলিং ওনেস প্রথমে হতবাকই হয়েছিলেন। কারণ এর আগে কোনো গবেষক এবং চিন্তকই, তিনি তাত্ত্বিক হোন অথবা পরীক্ষামূলক হোন, এটা অনুমান করতে পারেননি, অতিপরিবাহীর মতন একটি দশা বাস্তবে কোনো পদার্থের হওয়া সম্ভব। যদিও প্রাথমিকভাবে তাঁর সেই পরীক্ষার পরে মনে হয়েছিল হয়তো সেটা পরীক্ষারই কোনো ঘাটতি। কিন্তু অনেকবার সেই পরীক্ষা পরিচালনা করে দেখা গেল বাস্তবেই এটি পদার্থের একটি বিশেষ ধর্ম। মজার ঘটনা হল, সেই পারদে সামান্য পরিমাণ সোনা অথবা ক্যাডমিয়াম মেশানো হলেও পারদের অতিপরিবাহিতার ধর্মের বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। যদি তা হয়েও থাকে, তা অতীব সামান্য, এবং তা তাৎপর্যহীন। ১৯১৩ সালে হাইকে কেমারলিং ওনেস এই প্রভাবকে ‘সুপরা-কন্ডাক্টিটভিটি’ নামে অভিহিত করেন। পরে সেই নামটি তিনি বদলে দিয়ে বলেন ‘সুপার-কন্ডাক্টিভিটি’, আর বাংলায় আমরা বলতে পারি অতিপরিবাহিতা। ১৯১৩ সালেই তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তবে তাঁর সেই নোবেল পুরস্কারের পিছনে কারণটি ছিল তাঁর অনবদ্য সব কাজ যা নিম্ন তাপমাত্রাকে কেন্দ্র করে, এরই মধ্যে অন্যতম হিলিয়াম গ্যাসের তরলীকরণ। নোবেল-কমিটির বিবৃতিতে পুরস্কারের প্রণোদনের যুক্তি ছিল ঠিক এইরকম: “for his investigations on the properties of matter at low temperatures which led, inter alia, to the production of liquid helium.” অতিপরিবাহীকে মুখ্য করে তিনি যে নোবেল পুরস্কারটি পাননি, তার সপক্ষে অবশ্যই কিছু যুক্তি দেওয়া যায়। প্রথমত, ১৯১৩-র সমসাময়িককালে এই সদ্য আবিষ্কৃত পরীক্ষালব্ধ ফলকে যথাযথভাবে সমর্থন করার মতন তাত্ত্বিক ধারণা বিজ্ঞানীদের হাতে মজুত ছিল না। দ্বিতীয়ত, সেই আবিষ্কারের ফলে আগামীদিনে বিজ্ঞানচর্চার কী লাভ হতে পারে, সর্বোপরি মানুষের কী উপকারে আসতে পারে, সেই ধারণারও অভাব ছিল। ঘটনা যাই হোক, তবে সেই আবিষ্কার যে অনবদ্য, সেই ধারণাতে কারও কোনো সংশয় না-থাকারই কথা।
এগোতে থাকল অতিপরিবাহী নিয়ে গবেষণা ১৯১১ সালে অতিপরিবাহিতা আবিষ্কারের পরে, বিষয়টি নিয়ে গবেষণা এবং কাজকর্ম আর থেমে থাকেনি, পরিবর্তে বেড়েছে, আজও তা চলেছে জোরকদমে। একেবারে প্রথমদিকে অনেকেই মনে করেছিলেন এই পর্যবেক্ষণ হয়তো শুধু পারদ ধাতুর জন্যই যুক্তিসিদ্ধ এবং সেখানেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে টিন ধাতুতেও দেখা গেল সেই একই ধর্ম, লেডেও প্রদর্শিত হল সেই ধর্ম। একের পর এক আরও বিভিন্ন ধাতুতে সেই অতিপরিবাহিতার ধর্মগুলি বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে যে ঘটনা সবার কাছে একটু অবাকই লেগেছিল, তা হল, যেসমস্ত ধাতুগুলি, যেমন তামা, সোনা, রুপা, কারেন্টের অত্যন্ত সুপরিবাহী, তারা কিন্তু অতিপরিবাহী ধর্ম প্রদর্শন করতে নারাজ। আবার অন্যদিকে টিন, পারদ, গ্যালিয়াম এইসমস্ত ধাতুগুলি, যাদের একটিও কারেন্টের খুব ভালো পরিবাহী নয়, অথচ তারাই অতিপরিবাহীর বিশেষ ধর্মগুলো দর্শায়। সে কীরকম কথা! গত শতাব্দীর বিশের দশকে তাই অনেকের কাছেই এই ঘটনা ছিল এক বিরাট ধাঁধা। এ কী করে সম্ভব, কারেন্টের সুপরিবাহী নয়, অথচ অতিপরিবাহী। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ধাতু, সংকর ধাতু, যৌগকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলেছে। লেড, টিন, নায়োবিয়াম থেকে শুরু করে ভিন্ন ধাতু, সংকর ধাতু, যৌগতে এই অতিপরিবাহিতার ধর্ম লক্ষ করা যায়। তাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন ধাতুতে এই অতিপরিবাহিতার ধর্মকে বুঝতে প্রায় সময় লেগে গেল আরও কয়েক দশক। ষাটের দশক অতিপরিবাহিতার জন্য একটি অবিস্মরণীয় সময়। ১৯৫৭ সালটি পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোনও বলা যায়। জন বার্ডিন (John Bardeen (১৯০৮–১৯৯১), লিয়ন কুপার (Leon N. Cooper, ১৯৩০) আর জন শ্রিফার (John Robert Schrieffer (১৯৩১–২০১৯) নামে তিন মার্কিন বিজ্ঞানী নিয়ে এলেন অতিপরিবাহিতার সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রমাণিত তত্ত্ব ‘বিসিএস থিওরি’। এখানে উল্লেখ্য, জন বার্ডিন এমন একজন পদার্থবিদ যিনি দু’বার নোবেল পুরস্কার পান। প্রথমবার পেয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে যুগ্মভাবে উইলিয়াম শকলের (William Bradford Shockley (১৯১০–১৯৮৯) সাথে, (ট্রান্সসিস্টার এবং অর্ধপরিবাহীর উপর বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজকর্মের জন্যে)। বিসিএস সাড়া জাগানো তত্ত্বই জানালো, দুটি ইলেকট্রন, সম-আধানের (চার্জ) হলেও, পদার্থের আণবিক কম্পন (ল্যাটিস ভাইব্রেশান) তাদের একসাথে বেঁধে দিতে পারে। আর তারা তখন একে অপরকে বিকর্ষণ করে না। পদার্থের মধ্যে দিয়ে বিনা বাধায় চলাচল করে। এই ইলেকট্রন-জোড়াকে বলা হয় ‘কুপার পেয়ার’ (Cooper pair)। ১৯৭২ সালে এই কাজের জন্য তিন জন একসাথে নোবেল পুরস্কার পান। সিসা, টিন, পারদ, অ্যালুমিনিয়াম, জিঙ্ক, প্ল্যাটিনাম এবং আরও অনেক পদার্থের অতিপরিবাহিতা ধর্মটি ‘বিসিএস থিওরি’ দিয়ে খুব ভালো ব্যাখ্যা করা যায়।
ফারমি-সমুদ্র অতিপরিবাহী পদার্থের সাধারণ দশায়, কিন্তু যারা নিম্ন তাপমাত্রায় মেনে চলে বিসিএস থিওরি, তাদের কক্ষ-তাপমাত্রায় পদার্থের মধ্যে অবস্থিত ইলেকট্রনগুলি, যাদের বলা হয় কন্ডাকশন ইলেকট্রন, পদার্থের মধ্যে ক্রমাগত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছোটাছুটি করে, একদিকে এদের আধান যেমন ঋণাত্মক, এবং অন্যদিকে এরা কোনো একটি নির্দিষ্ট পরমাণুর সাথে আবদ্ধ থাকে না। কিন্তু অবশিষ্ট ধনাত্মক আধানগুলি ক্রিস্টাল ল্যাটিসে একটি নির্দিষ্ট স্থানেই বসে থাকে। পদার্থের মধ্যে অবস্থিত ইলেকট্রনগুলিকে একসাথে বলা হয় ফারমি সি (ফারমিয়নের সমুদ্র)। যেমন করে জলের অণুগুলি দিয়ে সমুদ্রের গভীরতা বাড়ে এবং কমে, ঠিক তেমনই ইলেকট্রনগুলির বিভিন্ন অবস্থানে থেকে ফারমি-সিয়ের বিভিন্ন স্তর ভর্তি করে, যদিও একটু নির্দিষ্ট মান অবধি তা ভর্তি করতে পারে। সমুদ্রের গভীর যেমন খুব শান্ত, কিন্তু সেই একই সমুদ্রের সারফেস বা উপরিতলে উথাল-পাথাল দশা, ঠিক তেমনই ধাতুর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনগুলি অনেকটা একইভাবে কাজ করে। তাপমাত্রা কমানোর সাথে অতিপরিবাহী দশায় দুটি ইলেকট্রন জোট বেঁধে তৈরি করে কুপার পেয়ার। কুপার পেয়ার তৈরি হওয়া বিষয়টি কিন্তু একেবারেই সহজ নয়। এখানে মনে রাখতে হবে দুটি ইলেকট্রন একসাথে জোট বাঁধছে। তার মানে দুটি একই স্পিনের বা ঘূর্ণনের এবং একই আধানের ফারমিয়ন একসাথে জোট বাঁধছে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মৌলিক নীতি অনুযায়ী তা তো হওয়ার কথা নয়। সাধারণ বিজ্ঞানের জ্ঞান অনুযায়ী কুলম্বের বিকর্ষণবলের নীতি জানায় দুটি সম-আধান একে অন্যকে শুধুমাত্র বিকর্ষণই করতে পারে। তাহলে তারা জোট বাঁধবে কী করে!
জোট বাঁধবে কী করে! অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে দুটি ইলেকট্রন জোট বাঁধে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মাধ্যমে, যার আধান কিনা ধনাত্মক। ক্রিস্টাল ল্যাটিসের ধনাত্মক আধানগুলি একজায়গায় বসে থাকে বটে, কিন্তু তারা ক্রমাগত নড়াচড়া করতে থাকে। তুলনা জন্যে বলা যায়, কোনো একটি অবোধ শিশুকে তার বসার চেয়ারে আবদ্ধ করে রাখলে, সে একই জায়গায় থাকে বটে কিন্তু একেবারেই স্থির থাকে না। সে অত্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে। কেউ যদি তাকে উত্তেজিত করে, মানে হাসায়, খেলার জন্যে প্রেরণা দেয়, সে ওই একস্থানে বসে থাকে বটে কিন্তু তার নড়াচড়া অনেক বেড়ে যায়। ঠিক তেমনই ক্রিস্টাল ল্যাটিস একজায়গার থাকে বটে এবং কিন্তু থাকে তাতে ক্রমাগত কম্পিত দশা। ল্যাটিস কম্পনের যে কোয়ান্টাম বা পরিমাণ তাকে বলা হয় ফোনন। ক্রিস্টাল ল্যাটিসের যে উত্তেজনা বা শক্তি তার পরিমাণই হল ফোনন। যেমন আলোর শক্তির বা উত্তেজনার কোয়ান্টাম ফোটন, চুম্বকত্বের শক্তির, উত্তেজনার কোয়ান্টাম ম্যাগনন। তাপমাত্রা বাড়ালে ল্যাটিসের কম্পন অনেক বাড়তে থাকে, তার মানে ফোননের শক্তিও অনেক বাড়তে থাকে। অতিপরিবাহীতে এই ইলেকট্রন এবং ফোননের যে সংযোগ তার উপরই ভিত্তি করে অনেককিছু ঘটে। এটা পরিষ্কার, যেসমস্ত ধাতু অত্যন্ত সুপরিবাহী, তাদের ক্ষেত্রে ইলেকট্রন এবং ফোননের মধ্যে সংযোগ অনেক কম, কারণ সেক্ষেত্রে ইলেকট্রন পদার্থের মধ্য দিয়ে অতি সহজে প্রবাহিত হতে পারে, কিন্তু যেসমস্ত ধাতু অত ভালো পরিবাহী নয়, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রন পদার্থের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় বারবার বিক্ষিপ্ত হয়, তাই ইলেকট্রন এবং ফোননের মধ্যে যে সংযোগ তা থাকে অনেক বেশি। অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে ইলেকট্রন এবং ফোননের সংযোগ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার আভাস এইখান থেকেই আসে, যেসমস্ত ধাতু সুপরিবাহী নয়, তারা আবার অতিপরিবাহী, অন্যদিকে যারা অত্যন্ত সুপরিবাহী তারা আবার অতিপরিবাহী নয়। তাই ইলেকট্রন এবং ফোননের সংযোগ যে অতিপরিবাহিতা ধর্মের জন্যে আবশ্যক তা এই সাধারণ যুক্তি থেকে আমরা বুঝতে পারি। ইলেকট্রন এবং ফোননের সংযোগের মাধ্যমে কুপার পেয়ার তো তৈরি হল, কিন্তু শুধুমাত্র কুপার পেয়ার তৈরি হওয়া মানেই অতিপরিবাহিতা নয়।
কুপার পেয়ার মানেই কী অতিপরিবাহী এর সাথে যেটা আবশ্যক, তা হল যেসমস্ত কুপার পেয়ার তৈরি হল তাদের একটা বড় অংশের সম্মিলিতভাবে একটি বিশেষ কোয়ান্টাম দশায় আসা। অৰ্থাৎ দশার একটি পরিবর্তন ঘটা আবশ্যক। এই ঘটনাকে বলা হয় বোস কন্ডেনসেশন। ইলেকট্রনদের ক্ষেত্রে এই বোস কন্ডেনসেশন ঘটা সম্ভব নয়। তার কারণ ইলেকট্রন একটি ফারমিয়ন, এর স্পিন ১/২ এবং সে মেনে চলে পাউলি এক্সক্লুশন নীতি অথবা পাউলির বর্জনের নীতি। পাউলির বর্জননীতি বলতে বোঝায় দুই বা তার অধিক অভিন্ন ফারমিয়ন (মৌলকণা এবং যার স্পিন অর্ধ পূর্ণসংখ্যা) কখনোই একটি সুনির্দিষ্ট কোয়ান্টাম দশায় একসাথে বসবাস করতে পারবে না। ইলেকট্রন যেহেতু একটি ফারমিয়ন সেই ক্ষেত্রে দুটি ইলেকট্রন কখনোই একটি অভিন্ন কোয়ান্টাম স্টেটে বা দশায় থাকতে পারবে না। অন্যদিকে বোসন বলতে বোঝায় মৌলকণা যার স্পিনের মান একটি পূর্ণসংখ্যা (যেমন ১), এবং বোসন পাউলির বর্জননীতি মেনে চলে না, ফলত যেকোনো সংখ্যার অভিন্ন বোসন একটি নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম দশায় অবস্থান করতে পারে। বোসন কণার ক্ষেত্রে, ইলেকট্রনের সাথে তুলনা করলে, একটি কোয়ান্টাম দশায় কীভাবে বসবাস করবে সেই নিয়ে ততটা ঝামেলা নেই। যত ইচ্ছা কণা একটি অভিন্ন দশায় থাকতে পারে যদি কিনা তা সর্বনিম্ন শক্তিস্তর হয়, এবং তা ঘটে খুবই
নিম্ন তাপমাত্রায়। কুপার পেয়ার হল একধরনের বোসন। দুটি ইলেকট্রন জোট বেঁধে তারা এখন একটি বোসনে পরিণত হয়েছে, অর্থাৎ তাদের স্পিন হয়েছে একটি পূর্ণসংখ্যা তাই কুপার পেয়ারদের বোস কন্ডেনসেশন হতে কোনো আপত্তি নেই। বিসিএস তত্ত্ব এখনও অবধি সাধারণ অতিপরিবাহীকে ব্যাখ্যা করার জন্যে সবচেয়ে প্রচলিত একটি তত্ত্ব। তা বলে এই নয়, এটিই একমাত্র তত্ত্ব। এই নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এবং প্রচুর তত্ত্বও এসেছে। তবে বিসিএস তত্ত্বই আজ অধিক স্বীকৃত।
উচ্চ তাপমাত্রার অতিপরিবাহী বহু বছরের পরিশ্রমে ১৯৮৬ সালে এলেক্স ম্যুলার (Karl Alexander Müller (জন্ম এপ্রিল ২০, ১৯২৭) ও জর্জ বেডনর্জ (Johannes Georg Bednorz (জন্ম ১৬ মে ১৯৫০) নামে দুই বিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডে ‘ল্যান্থানাম বেরিয়াম কপার অক্সাইড’ নামে একটি যৌগে ৩৫ কেলভিন তাপমাত্রাতেও অতিপরিবাহিতা আবিস্কার করেছেন। সেই কাজের জন্য তাঁরা নোবেল পুরস্কারও পেলেন। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যে তাপমাত্রার নীচে অতিপরিবাহী পদার্থ পাওয়া যায় স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে তা হল প্রায় ১৩৫ কেলভিন। এর পরে অনেক অতিপরিবাহী পদার্থই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। ২০১৫ সালে জার্মানিতে একদল বিজ্ঞানী প্রায় ১৫ লক্ষ বায়ুমণ্ডলীয় চাপে কঠিন হাইড্রোজেন সালফাইড যৌগে দেখলেন, ‘সঙ্কট-তাপমাত্রা’ (এখানে সঙ্কট-তাপমাত্রা বলতে বোঝানো হয়েছে যে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পদার্থের দশার পরিবর্তন ঘটে) মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে অ্যান্টার্টিকাতেও তাপমাত্রা কখনো পৌঁছে যায় প্রায় মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এতে নতুন করে এক আলোর দিশা বিজ্ঞানী মহলে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির কথা ভেবে, যথাযথ প্রয়োগের কথা ভাবলে, কবে যে স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে এক সুলভ অতিপরিবাহী পদার্থের আবিষ্কার হবে, যা অতিপরিবাহিতা ধর্ম প্রকাশ করবে কক্ষ-তাপমাত্রার উপরেও, সেদিনই হতে পারে এক বিপ্লব। চাকা, আগুন, উড়োজাহাজ, ইন্টারনেট যেমন সভ্যতার এগিয়ে চলার চাকাকে শুধু ত্বরান্বিতই করেছে, ঠিক তেমনই সেই আবিষ্কারও হয়ত এনে দেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে এক অভিনব বিপ্লব। অতিপরিবাহিতা নিয়ে একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে, যা মার্টিন এবং রুহেমান তাঁদের নিম্ন তাপমাত্রায় পদার্থবিদ্যা বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘অতিপরিবাহিতা এমন একটি ঘটমান বিষয় যা প্রত্যেক পদার্থবিদই আবিষ্কার করতে চাইবেন।’ (Martin and B. Ruhemann refer in their book Low Tem-perature Physics as “the kind of phenomenon that every physicist would like to have discovered”)
শুধুই কি আদর্শ পরিবাহী অতিপরিবাহীকে ভালো করে বুঝতে গেলে প্রথমেই একটি প্রশ্ন আসে, অতিপরিবাহিতা কি শুধুমাত্র একটি আদর্শ পরিবাহী, না এর থেকেও আলাদা কিছু? একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নীচে চলে গেলে পরিবাহীর রোধ শূন্য হয়ে গেল, এটাই কিন্তু অতিপরিবাহিতার একমাত্র বৈশিষ্ট নয়। এরই সাথে যে আশ্চর্য করে দেওয়া ধর্ম মজুত থাকা দরকার তাকে বলে মাইসনার এফেক্ট বা মাইসনার ক্রিয়া। অতিপরিবাহী যদি শুধুমাত্র একটি আদর্শ পরিবাহী হত, তাহলে যা ঘটত, একটি অতিপরিবাহীকে তার ক্রিটিক্যাল বা সঙ্কট-তাপমাত্রার নিম্নে নিয়ে এলে সেই পদার্থে প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্র, যা ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার উপরে সেই পদার্থে অনায়াসে প্রবেশ করেছিল, দশার পরিবর্তনের পরেও সেই চুম্বকক্ষেত্র একইভাবে বণ্টিত থাকত। কিন্তু বাস্তবে অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে তা ঘটে না। সাধারণ পরিবাহী থেকে যে তাপমাত্রায় পদার্থ অতিপরিবাহী পদার্থে পরিণত হয় সেটাই হল সঙ্কট-তাপমাত্রা। অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা কমানোর সাথে যখন দশার পরিবর্তন ঘটে ঠিক ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার নীচে প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্র পদার্থের মধ্যে থেকে বিতাড়িত হয়। এই কারণেই কোনো অতিপরিবাহী একটি চুম্বকের নীচে বসালে এবং অতিপরিবাহীকে তার ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার নীচে নিয়ে গেলে, অতিপরিবাহীটি তখন শূন্যে ভেসে থাকে। অতিপরিবাহীর উপরিভাগে একধরনের প্রবাহিত কারেন্ট এর জন্যে দায়ী। এই প্রবাহিত কারেন্টকে বলা হয় স্ক্রিনিং কারেন্ট। অতিপরিবাহীর উপরিভাগে এই কারেন্ট একটি পর্দার মতন কাজ করে, যা বাইরের চুম্বকক্ষেত্রকে অতিপরিবাহী থেকে আলাদা করে রাখে। স্ক্রিনিং কারেন্ট আবার তৈরি করে একপ্রকারের চুম্বকক্ষেত্র, যা বাইরে থেকে প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্রের সাথে বিকর্ষণের বল হিসেবে কাজ করে। এবং এই বিকর্ষণ বল এতটাই প্রবল হতে পারে, যা মহাকর্ষের প্রভাবে বস্তুর নীচে আসার থেকে বেশি হলে, চুম্বকটিকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে পারে এবং একটি ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই বোঝাই যাচ্ছে বাইরে থেকে প্রয়োগ করা চুম্বকক্ষেত্রের মান যদি খুব বেশি হয়, অথবা চুম্বকটির ওজন যদি খুব বেশি হয়, তাহলে চুম্বকটি সেই অতিপরিবাহীর উপরে শূন্যে আর ভেসে থাকতে পারে না। চুম্বকক্ষেত্রের মান যত বাড়ানো হয়, একটি নির্দিষ্ট সীমার পরে সেই পদার্থ আবার তার অতিপরিবাহী ধর্ম হারিয়ে সাধারণ পরিবাহীতে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে একটি অধিক ক্ষমতার চুম্বককে যদি অতিপরিবাহীর নীচে বসানো যায়, সেই অতিপরিবাহীকে ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার নীচে নিয়ে এলেও সে কিন্তু তখন আর শূন্যে ভেসে থাকতে পারে না। কারণ চুম্বকক্ষেত্র বিতাড়িত না হয়ে অতিপরিবাহীর মধ্যেই প্রবেশ করে যাবে একটি সীমার পরে। কীভাবে সেই চুম্বকক্ষেত্র অতিপরিবাহীর মধ্যে প্রবেশ করবে, এবং চুম্বকক্ষেত্রের অতিপরিবাহীর গভীরে গঠন কেমন হবে, তার উপর আবার নির্ভর করবে অতিপরিবাহীর প্রকার এবং ভিন্নতা। কীভাবে অতিপরিবাহী সাধারণ পরিবাহীতে রূপান্তরিত হবে, তার উপর নির্ভর করে অতিপরিবাহীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তারা হল, যথাক্রমে টাইপ-১ এবং টাইপ-২। অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মের উপর ভিত্তি করে অতিপরিবাহীকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হল কনভেনশনাল (বাংলায় বলা যায় প্রচলিত) আর দ্বিতীয়টি আনকনভেনশনাল (বাংলায় বলা যায় অপ্রচলিত) অতিপরিবাহী।
একাধিক আধুনিক পরীক্ষার সাহায্যে এদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারি। তার জন্যে অবশ্যই কিছু বিশেষ পরীক্ষার সাহায্যও নিতে হয়। প্রচলিত অতিপরিবাহী বলতে বোঝায় যেসমস্ত পদার্থ বিসিএস থিওরি মেনে চলে। এই যেমন অ্যালুমিনিয়াম, টিন, পারদ, নায়োবিয়াম, জিঙ্ক, এদের এই প্রচলিত পরিবাহীর মধ্যে রাখা যায়। যারা অগ্রবর্তী পাঠক তাঁদের জন্যে আর একটু গভীরে বললে বলা যায়, এরা অতিপরিবাহীতে তরঙ্গের প্রতিসাম্য অর্ডার প্যারামিটার থাকে তা কিন্তু এস-তরঙ্গ। এবং যে গ্যাপ তৈরি হয়, তা হয় ঠিক আইসোট্রপিক।
অতিপরিবাহী নিয়ে গবেষণার একেবারে প্রথমদিকে অনেকেরই মনে হয়েছিল অতিপরিবাহী পদার্থের একটি সুস্থিত দশা নয়। তার মানে অতিপরিবাহী পদার্থের ধর্ম নির্ভর করে কীভাবে পদার্থটির তাপমাত্রা কমানো হয়েছে অথবা বাড়ানো হয়েছে, সেই ইতিহাসের উপর। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। এটি পদার্থের একটি থার্মোডাইনামিক দশা।
যখনই বোঝা গেল অতিপরিবাহী পদার্থের একটি সুস্থিত এবং থার্মোডাইনামিক দশা, সেই মুহূর্তে আলোচনার অন্য একটা পথও খুলে গেল। অতিপরিবাহী দশাকে বোঝার জন্যে তৈরি করা হল ‘টু-ফ্লউইড মডেল’ নামে একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্বের ভিত্তি ছিল, অতিপরিবাহী পদার্থে দুইধরনের ইলেকট্রনের উপস্থিতি। একধরনের ইলেকট্রন যারা অতিপরিবাহীর অতিপরিবাহী ধর্মের জন্যে দায়ী, এবং অন্য প্রকারের ইলেকট্রন যারা সাধারণ পরিবাহীর মতনই ধর্ম নিয়ে চলে। অতিপরিবাহী পদার্থের তাপমাত্রা যখন কমানো হয়, তাপমাত্রা কমানোর সাথে, এবং ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার নীচে, পদার্থের মধ্যে অতিপরিবাহী ইলেকট্রনের ভগ্নাংশ বাড়তে থাকে, এবং সাধারণ ইলেকট্রনের ভগ্নাংশ কমতে থাকে। অন্যদিকে, যখন তাপমাত্রা বাড়ানো হয় ঠিক উলটো ঘটনাটি ঘটে—পরিবাহীতে সাধারণ ইলেকট্রনের অংশ বাড়তে থাকে এবং অতিপরিবাহী ইলেকট্রনের অংশ কমতে থাকে, এবং ক্রিটিক্যাল তাপমাত্রার উপরে কোনো অতিপরিবাহী ইলেকট্রনের অস্তিত্ব আর থাকে না। এই ধারণা গুণগত দিক থেকে ঠিকই ছিল, তবে পরিমাণগত দিক থেকে বুঝতে বেশ অসুবিধা ছিল। সেখানেই যে অনবদ্য ধারণা এল তা হল বিজ্ঞানী লন্ডনের কোয়ান্টাম তত্ত্ব। লন্ডন বুঝেছিলেন অতিপরিবাহীকে বুঝতে হলে যেভাবে ইলেকট্রনের গতিকে বোঝা হয়, ইলেকট্রিক ফিল্ড বা ক্ষেত্র অথবা বিভবের পার্থক্যের জন্যে বোঝা হয়, এক্ষত্রে ঠিক সেইভাবে ভাবলে চলবে না। সাধারণ পরিবাহীতে যেভাবে একটি ইলেকট্রন বিদ্যুৎ পরিবহনের কাজ করে, সেইভাবে শুধু চিন্তা করলে আর চলে না। বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য এ যাবৎ জানা শুধু ওহমের ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদি সূত্রের মতন ভাবলে চলবে না, কিছুটা অন্যভাবে ভাবতে হবে।
২০২২ সালে অতিপরিবাহিতা বিজ্ঞানের মৌল গবেষণার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ঠিক তেমনই প্রযুক্তির নিরিখে এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। শুধু অপেক্ষা কবে কক্ষ-তাপমাত্রায় সাধারণ চাপে অতিপরিবাহী পদার্থ বিজ্ঞানীদের হাতে আসবে।
Comments