More is Different and Quantum Protectorate
যত বেশি তত ভিন্ন এবং কোয়ান্টাম প্রোটেকটরেট (কোয়ান্টাম অভিভাবকত্ব)
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের (প্রকৃত নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়) ‘যত মত তত পথ’ বাক্যটি আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা। ধার্মিক এই মানুষটির ধর্মকে কেন্দ্র করে সেই উক্তিটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খোঁজার প্রচেষ্টা আমাদের নয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়লে, এবং বিভিন্ন আলোচনা শুরু করলে ‘যত মত তত পথ’ এই বাক্যটিকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। একে সমর্থন করাও ন্যায়সঙ্গত বলা যায়। কিন্তু এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় কিছুটা অন্যরকমের। ‘যত মত তত পথ’ ঠিক এই বাক্যটি নয়, পরিবর্তে শিরোনামে যে বাক্যটি আছে, মানে ‘যত বেশি তত ভিন্ন’। আমাদের কাছে এই বাক্যটির প্রেরণা “More is different” নামক শিরোনামের একটি প্রবন্ধ। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে আমেরিকার সায়েন্স পত্রিকায়। বাংলায় সরাসরি লিখলে বলা যায় ‘যত বেশি তত ভিন্ন’। এখানে কোনো মননশীল মানুষ অন্যভাবেও ভাবতে পারেন এবং সেইভাবে লিখতে পারেন, যেমন ‘অধিক মানেই ভিন্ন’, ‘আরত্ত মানেই বিভিন্ন’, ‘অধিক মানেই স্বতন্ত্র’ ইত্যাদি। অন্যরা অন্য কিছু বলতে পারেন। আপাতত সেই বিতর্কে আমরা গেলাম না। এই প্রবন্ধটি খুঁটিয়ে পড়ার সময়ে শ্রীগদাধর চট্টোপাধ্যায়ের ওই উক্তিটি মাথায় এসেছিল বলে এখানে উল্লেখ করা হল। যদিও এই দুটি বাক্যের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা আমরা করিনি। একজন ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক এবং অন্যজন বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিদ এবং নোবেলজয়ী। কেউ এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে চাইলে খুঁজতেও পারেন। কিন্তু তা আমাদের আপাতত উদ্দেশ্য নয়।
রিডাকশনিজম বলতে কী বোঝায়?
What is reductionism?
জটিল জিনিসকে সরল খণ্ডাংশে বিশ্লিষ্ট করার নীতিকে কেন্দ্র করে দার্শনিকদের মধ্যে কিছু ভিন্ন মতবাদ থাকলেও থাকতে পারে, তবে অধিকাংশ সক্রিয়, যুক্তিবাদী আধুনিক বিজ্ঞানী অন্তত মেনে নেবেন এই মতবাদকে। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের পরিভাষায় একে বলা হয় রিডাকশনিজম। মোদ্দা কথা যে-কোনো জটিল এবং বৈচিত্র্যময় ঘটনার বৈশিষ্ট্যগুলি আরও কয়েকটি কম মৌল উপাদানগুলির গতিশীলতার দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমাদের শরীর এবং মন কীভাবে কাজ করে, অথবা সমস্ত সজীব এবং নির্জীব পদার্থ যাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশদ জ্ঞান আছে, বর্তমানের এবং একটা সময়ের (মানে ৩০-৪০ বছর আগেও) বেশকিছু বিজ্ঞানী ধরে নেন অথবা মেনে নেন এই সমস্তকিছুই চালিত হয় কিছু মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে। এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে এই নীতিগুলি কার্যকর মোটামুটি স্বাভাবিক দশাতে। কিছু চরম পরিস্থিতিতে এই মৌলিক নীতিগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আইজাক নিউটনের যে মহাকর্ষবলের নীতি, তা যেমন গাছ থেকে আম মাটিতে পড়ার ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, একটি ঢিলকে আকাশে ছুঁড়লে সেই ঢিলটি মাটিতে নেমে আসে ঠিক সেই একই নীতি মেনে, ঠিক তেমনই পৃথিবী কেন সূর্যকে কেন্দ্র করে কোনো একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে অথবা কিছু স্যাটেলাইট যা মানুষের দ্বারা উৎক্ষেপিত, কেন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে, সেই একই নীতিই তার ব্যাখ্যার জন্যে যথেষ্ট। একটি নির্দিষ্ট পরমাণুর ধর্ম দিয়ে যেমন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বোঝা যায়, ঠিক তেমনই অগ্নিশিখার বর্ণের ব্যাখ্যা করা যায়। সহজ করে বললে কিছু মৌল নীতি জানা থাকলেই এই বিশ্বের ঘটমান অধিকাংশ ঘটনারই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একেই এক কথায় বলা যায় রিডাকশনিজম। অন্তত বিংশ শতাব্দীতে এই মতবাদকে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই শুধু নয়, বেশকিছু দার্শনিকও মেনে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের বহু বিজ্ঞানীরই প্রচেষ্টা ছিল ‘থিয়োরি অফ এভরিথিং’ নামে যদি এমন একটি সুন্দর গাণিতিক সমীকরণ সৃষ্টি করা যায়, যে-গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে বিশ্বের সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে, তবেই আসবে প্রকৃত সাফল্য। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রচেষ্টায় মেতে ছিলেন এবং আছেন বিশ্বের বহু নামজাদা প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। তাহলে কি ভালোই-না হতো–একটি মাত্র গাণিতিক সমীকরণ, আর তা দিয়ে প্রকৃতির সমস্ত মৌল নীতিগুলির ব্যাখ্যা। সেটা অবশ্য সফল হয়নি এখনও অবধি।
রিডাকশনিজম এই মতবাদ কিন্তু প্রকৃতির বিভিন্ন জটিল ঘটনা যা ঘটে চলেছে অথবা ক্রমাগত যা মানুষের, বিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণাগারে বিভিন্ন দশাতে, ভিন্ন বাহ্যিক পরিস্থিতিতে অথবা গবেষণাগারের বাইরেও আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে, উদীয়মান সেইসব বিস্ময় যা সম্পূর্ণরূপে এখনও বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যার বাইরে, সেক্ষেত্রে এই রিডাকশনিজম মতবাদ কতটা প্রযোজ্য তা শুধুমাত্র ভাবার নয় বিস্তারিত আলোচনারও বিষয়। অতিপরিবাহিতা এইরকমই পদার্থের এক উদীয়মান বৈশিষ্ট্য যা রিডাকশনিজম মতবাদের আওতায় আসে কিনা সেই নিয়েই আমাদের পরবর্তী আলোচনা।
অতিপরিবাহিতা বলতে কী বোঝায়?
What is superconductivity?
প্রথমে আমরা একটু বুঝে নিই অতিপরিবাহিতা বলতে কি বোঝায়। অতিপরিবাহিতা পদার্থের একটি নতুন দশা, যা নিম্ন-তাপমাত্রায় ঘটে, যেখানে পদার্থ রোধ-বিহীন একটি দশায় পরিণত হয়। কোনো তারের মধ্য দিয়ে যদি কারেন্ট পাঠানো হয়, মানে ইলেকট্রনের স্রোত পাঠানো হয়, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রনগুলি পরিবাহীর মধ্য দিয়ে বিনা বাধায় যাতায়াত করতে পারে না। তারা বিভিন্ন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তার ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই জুল-হিটিং। সেই কারণে প্রবাহিত শক্তিরও যথেষ্ট অপচয় ঘটে। কিন্তু অতিপরিবাহী পদার্থের মধ্য দিয়ে কারেন্ট পাঠালে, সেই কারেন্ট বিনা বাধায় প্রবাহিত হতে পারে। এরই সঙ্গে অতিপরিবাহী পদার্থের মধ্যে বাইরে থেকে চুম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হলে, সেই চুম্বক ক্ষেত্র অতিপরিবাহী পদার্থ থেকে বিতাড়িত হয়। এই দুটোই হলো অতিপরিবাহী পদার্থকে পরীক্ষামূলকভাবে শনাক্ত করার প্রাথমিক উপায়। তবে তার আগে আমরা আর একটু জেনে নিই। এই যে রিডাকশনিজম মতবাদ তা কঠিন পদার্থের গবেষণার ক্ষেত্রে কতোটা প্রযোজ্য। মানে কঠিন পদার্থবিদ্যা সেখানে কি আদপে রিডাকশনিজম মতবাদ একেবারেই প্রযোজ্য!
কঠিন পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে থিয়োরি অফ এভরিথিংবলতে কীবোঝায়?
What is the theory of everything in Solid State Physics?
কঠিন পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে থিয়োরি অফ এভরিথিং বলতে কী বোঝায় তা আমরা জানি। তা হলো শ্রোয়েডিংগার-সমীকরণ। ১৯২৬ সালের আগেই অস্ট্রীয় পদার্থবিদ এর্ভিন শ্রোয়েডিংগার এই সমীকরণ দিয়েছিলেন। জার্মান পদার্থবিদ ওয়েরনার হাইজেনবার্গ ১৯২৫ সালে দিয়েছিলেন এক নতুন সমীকরণ, নতুন এক গতিসূত্র, যার সঙ্গে নিউটনের সূত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। এই নতুন সূত্র দিয়ে বোঝা যায় পারমাণবিক জগতের রহস্য। কিন্তু সমস্যা ছিল হাইজেনবার্গের সমীকরণের সমাধান করা, যা খুব একটা সহজ নয়। সেই সমীকরণটির গঠনে গণিতের যেসব শাখা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই সময়কার পদার্থবিদদের কাছে সেইসমস্ত বিষয় ছিল একেবারেই অজানা। তাই হাইজেনবার্গের সমীকরণ কাজে লাগানো খুব একটি সহজ কাজ ছিল না। অন্যদিকে পদার্থবিদ এর্ভিন শ্রোয়েডিংগার যে সমীকরণ দিলেন, সেই সমীকরণের গাণিতিক ভিত্তির সঙ্গে সেই সময়কার পদার্থবিদদের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। আসলে হাইজেনবার্গ এবং শ্রোয়েডিংগার এঁদের দুইজনের সৃষ্ট এই দুই সমীকরণ একই মূল বার্তা বহন করে। শুধু হয়তো ব্যক্ত করার ভাষাদুটি আলাদা। যেমন একই সত্যকে যদি বাংলা এবং জার্মান ভাষায় বলা হয়, তাহলে শুনতে দুটোকে আলাদা লাগবে বটে, কিন্তু যাঁরা দুটো ভাষাই জানেন তাঁরা সত্যটি অনুধাবন করতে পারবেন। আমরা আজকে যাকে কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা বলি, পারমাণবিক রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে এই কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার সাফল্য প্রশ্নাতীত। এর সূত্রপাত ছিল হাইজেনবার্গ এবং শ্রোয়েডিংগারের হাত ধরেই। এঁরা দুইজনেই তাঁদের এই সৃষ্টির জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩২-এ নোবেল পুরস্কার পেলেন হাইজেনবার্গ এবং ১৯৩৩-এ পেলেন শ্রোয়েডিংগার।
শ্রোয়েডিংগার সমীকরণ
Schrödinger equation
কঠিন পদার্থের গবেষণার ক্ষেত্রে শ্রোয়েডিংগার সমীকরণকে বলা যায় থিয়োরি অফ এভরিথিং। একে থিয়োরি অফ এভরিথিং বলা হয় বটে, কিন্তু এর সীমাবদ্ধতাও আছে অনেক। সমীকরণটি সমাধান করা যায় যখন খুব অল্প কয়েকটি অণু নিয়ে কাজ করা হয়। শুধু তাই নয় এই সমাধান পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত ফলের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সঙ্গে। কিন্তু সেই হিসেব করার জন্যে অথবা গণিতের সমাধানের জন্যে যদি ১০টির বেশি অণুকে ধরা হয়, তাহলেই সেই সমীকরণের সমাধান শুধুমাত্র মানুষের জন্যে অসাধ্য নয়, একটি সুপার-কম্পিউটারও সেই সমাধান করে উঠতে পারে না। অণুর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, ঠিক ততই সেই গাণিতিক সমীকরণের সমাধান আসাধ্য হয়ে ওঠে। আমরা জানি একটা ডেলা পদার্থে মোটামুটি (১০)^২৩ [১০ to the power ২৩] সংখ্যক অণু থাকে। একের পিঠে ৫টি শূন্য থাকলে আমরা বলি তা এক লক্ষ, একের পিঠে ৭টি শূন্য থাকলে আমরা তাকে বলি এক কোটি, কিন্তু এখানে সংখ্যাটি, একের পিঠে ২৩টি শূন্য। তার মানে অনুমান করা যায় কী বিশাল মাপের অণুর সংখ্যা এক ডেলা পদার্থে উপস্থিত থাকে। যেখানে ১০টির বেশি অণু থাকলেই শ্রোয়েডিংগার-সমীকরণের সঠিক সমাধান প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে, সেখানে (১০)^২৩ [১০ to the power ২৩] অণু সম্বলিত যে পদার্থ তার সমাধান কী করে করা যাবে। বর্তমানে সেই মাপের কম্পিউটারের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই, ঠিক তেমনই আগামীদিনেও কখনো তা তৈরি করা সম্ভব হবে কিনা সেটাও একটা বড়োমাপের প্রশ্ন। অথচ আমরা প্রতিদিনের জীবনে যে পরিমাণ পদার্থ নিয়ে গবেষণা, নাড়াচাড়া করি, তা তো সেই এক ডেলা পরিমাণের কিছু কম নয়। একটা বড়োমাপের সিস্টেম, যেখানে প্রচুর সংখ্যক অণু বর্তমান, তা সত্ত্বেও কিছু গণনা অবশ্যই করা সম্ভব। সেইসব গণনার জন্যেই আমরা বলতে পারি একটি অণুর আকৃতি কেন এইরকম বা ওইরকম, রাসায়নিক বন্ধনগুলির দৈর্ঘ্য এবং শক্তির মান কত, পদার্থের স্থিতিস্থাপকতার ধর্মকে আমরা আন্দাজ করতে পারি। কেন কিছু পদার্থ স্বচ্ছ, কেন কিছু পদার্থ আলোর প্রতিফলক, কেন কিছু পদার্থ আলোকে শোষণ করে–এই সমস্তই প্রাথমিক স্তরে গণনা করা যায়। আমরা যদি সামান্য পরিমাণ পরীক্ষালব্ধ ফল পাই, তাহলে এটাও গণনা করা যায়, অণুর অনুবর্তিতা কিছু ছোটো অণুর, সহজ সরল রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার বা গতি, পদার্থের গঠনের দশার পরিবর্তন, চুম্বক-প্রবণতা, এমনকি কখনো কখনো অতিপরিবাহিতার অবস্থান পরিবর্তনের তাপমাত্রাও নির্ণয় করা যায়। কিন্তু কেউ যদি ভাবেন কোনোরকম পরীক্ষামূলক ইনপুট ছাড়াই শুধুমাত্র অঙ্ক কষেই, মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে পদার্থের উদীয়মান বেশকিছু ধর্মের ব্যাখ্যা করতে পারবেন, তাহলে কিন্তু সে-গুড়ে বালি। যেখানে পরীক্ষামূলক তথ্যের অভাব সেখানে শুধুমাত্র অঙ্ক কষে বহুকিছুই অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। অন্তত সেই গাণিতিক সমাধানের উপর ভিত্তি করে পদার্থ কী ধর্ম প্রদর্শন করবে, তার সম্পূর্ণ নির্ভুল দশা গণনা করা অসম্ভব। এইরকম জলজ্যান্ত বেশকিছু উদাহরণ মজুত। যেমন তরল হিলিয়াম ৩ আইসোটোপের দশা রেখাচিত্র, উচ্চ-তাপমাত্রার অতিপরিবাহীর সম্পূর্ণ প্রপঞ্চবাদ (ফেনোমেনোলজি) এইসব গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শুধু কি তাই এই যদি ধরে নিই প্রোটিনের কার্যকারিতা, অথবা মানুষের মাথা কী করে কাজ করে, মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এই সবই কিন্তু এই শ্রোয়েডিংগার-সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। মোদ্দা কথা হলো ওই রিডাকশনিজম মতবাদের যথার্থতা বা সার্থকতার সীমাবদ্ধতা আছে।
কঠিন পদার্থ এবং চুম্বক বিজ্ঞানের বিভিন্ন উদীয়মান অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে রিডাকশনিজম মতবাদ কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রসঙ্গত আমেরিকান নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ফিলিপ এন্ডারসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সায়েন্স পত্রিকায় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের শিরোনামটি ছিল “মোর ইজ ডিফারেন্ট”। সেই প্রবন্ধটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং প্রভাবশালী শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের গবেষণার ক্ষেত্রে নয়, সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানের দর্শনের ক্ষেত্রেও এবং প্রকৃতির মৌলিক নীতিগুলির অনুধাবনের ক্ষেত্রেও। তিনি যে কথাটি তাঁর সেই প্রবন্ধটিতে বলতে চেয়েছিলেন তা ঠিক এই রকমের। একটি প্রকৃত সিস্টেমে বা পদার্থে অসংখ্য অণু থাকে। এক ডেলা পদার্থে প্রায় (১০)^২৩ [১০ to the power ২৩] সংখ্যক অণু মজুত থাকে। অণুর সঠিক সংখ্যার কথা, অবশ্যই নির্ভর করবে সেই এক ডেলার ওজন কত, এবং সেই ডেলাটি কীসের। মানে তামার, জলের, পারদের অথবা অন্যকোনো মৌলের অথবা কোনো যৌগের। একটা কথা পরিষ্কার ১০-এর পিঠে ওই শূন্যের সংখ্যাগুলি তাতে খুব একটা বদলাবে না। মানে একের পরে শূন্যের সংখ্যা ২৩-এর খুব কাছাকাছিই থাকবে। তা ২৪, ২৫টিও হতে পারে অথবা ২১, ২২টিও হতে পারে। এখন সেই পদার্থটি সামগ্রিকভাবে যে ধর্ম প্রকাশ করতে পারে, তা কিন্তু প্রতিটি স্বতন্ত্র অণুর থেকে আলাদা হতেই পারে, এবং সেই সম্ভাবনাই বেশি। এবং অণুর সংখ্যা যত বাড়বে সেই একটি অণুর স্বতন্ত্র ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য থেকে অনেক বা সম্মিলিত অনেকগুলো অণুর প্রকাশিত ধর্ম, সেই একটি অণুর ধর্মকে শুধুমাত্র উপস্থিত অনুগুলির গুণিতক নয়। তাঁর প্রবন্ধের শিরোনামটিকে আক্ষরিক অর্থে লিখলে যেটা দাঁড়ায় তা হলো “যত বেশি তত ভিন্ন”। ফিলিপ এন্ডারসনের অবস্থান তুলনা করলে উদাহরণ হিসেবে তা স্টিফেন হকিং-এর অবস্থান থেকে অনেকটাই আলাদা। যেমন স্টিফেন হকিং একদা বলেছিলেন যখনই এই মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক নীতিগুলি মানুষ জেনে বা বুঝে ফেলবেন, তখন সমস্ত ম্যাক্রোস্কোপিক ঘটনাগুলির ওই মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানের শেষ
The end of science
গত শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে আমেরিকার এক লেখক, যাঁর নাম জন হরগ্যান, একটি বিতর্কিত বই প্রকাশ করেছিলেন। বইটির নাম ছিল দি এন্ড অফ সায়েন্স। বইটিকে বিতর্কিত এই কারণে বলা যায় যে দৃষ্টি নিয়ে এই বই লেখা তাতে বিজ্ঞানের ইতিহাসের অনেক বিস্তারিত বিবরণ হয়তো আছে, কিন্তু তাতে যথেষ্ট কৃতবিদ্য অনুমানের যে অভাব ছিল তা আজকে অন্তত এই বইটি প্রকাশিত হবার কুড়ি বছর পরে অনায়াসে বলা যায়। বিজ্ঞান কিন্তু তার সমহিমায়, প্রচণ্ড গতিবেগ নিয়ে ক্রমশ এগিয়েই চলেছে। বইটির মূল বিষয়বস্তু পদার্থবিজ্ঞানের শেষ, মানে সৃষ্টিতত্ত্বের শেষ, মানে অভিব্যক্তিমূলক জীববিজ্ঞানের শেষ, মানে সমাজবিজ্ঞানের শেষ, মানে স্নায়ুবিজ্ঞানের শেষ, মানে ক্যায়োপ্লেক্সিটি শেষ, মানে লিমিটোলজির শেষ। শেষ না হলেও, এইসব বিষয়ের আর বিশেষ কোনো বিকাশ, মানে মৌলিক কিছু আবিষ্কার, বা কাজকর্ম আর যে হবার নেই, তাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন নামজাদা গবেষক এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকা যেমন সায়েন্স, ফিজিক্স টুডে–র এইসব লেখা এবং মন্তব্যের উপর ভিত্তি করেই একটি বড়ো অংশ রয়েছে এ-বইয়ে। বিজ্ঞানের এক সুন্দর ইতিহাস বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে, এ নিয়েও কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। তবে বিজ্ঞানের শেষ যে অনুমান তা শুধু ভুলই নয়, তা অযৌক্তিকও। আমরা সেই বইয়ের বিতর্কে যেতে চাই না।
১৩০ বছর আগেও কেউ কী ভেবেছিল আমাদের জীবনে আসবে কম্পিউটার, আসবে আন্তর্জাল, আসবে টেলিভিশন, উড়োজাহাজ, স্পেইস-স্টেশন, পারমাণবিক বোমা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিরোগ্রাফি.........
ইতিহাসের পাতায় একটু পিছিয়ে গেলে, এই যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষেই চলে যাই–তখন কে জানত বা কে ভাবতে পেরেছিল, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আসবে কম্পিউটার, আসবে আন্তর্জাল, আসবে টেলিভিশন, উড়োজাহাজ, স্পেইস-স্টেশন, পারমাণবিক বোমা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিরোগ্রাফি, এন্টিবিয়োটিক্স, এম আর আই, অথবা মাইক্রোওভেন, এছাড়া আরও কতকিছু। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি, তা সে মৌলিক হোক অথবা প্রয়োগমূলক হোক আগামীদিনে কি সুযোগসুবিধা নিয়ে আসবে তা অনুমান করা সহজ কাজ নয়। থমাস একুইনাসের মতন দার্শনিকেরা নিশ্চয় অনুমান করতে পারেননি এইসব বিজ্ঞানের বিকাশের সাক্ষী থাকবেন বিংশ শতাব্দীর মানুষ। ৫০০০ হাজার বছর আগেও কেউ অনুমান করতে পারেননি, ৫০ বছর আগেও কেউ অনুমান করতে পারেননি, এখনও কেউ অনুমান করতে পারবেন না। এই পদার্থবিদ্যার কথাই যদি ধরি, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে কেউ কি অনুমান করতে পেরেছিলেন আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে মানুষের কাছে হাজির হবেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এত প্রভাব থাকবে বিগত ১০০ বছর ধরে বিজ্ঞান এবং দর্শনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ক্যায়স নিয়ে এত মাতামাতি হবে? কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং আপেক্ষিকতাবাদ খুলে দেবে কত নতুন দিশা আধুনিক বিজ্ঞানের এবং উন্মোচন করবে বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্র। এই দুই আবিষ্কার ঢেকে দেবে ছাপিয়ে দেবে নিউটনীয় পদার্থবিদ্যাকেও। শুধু তাই নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বেশকিছু পদার্থবিদ এমনও মনে করতেন তাঁরা বিশ্বের সমস্ত মৌলিক নীতিগুলি ইতিমধ্যে জেনে এবং বুঝে ফেলেছেন। কী মারাত্মক দর্পিত ছিল সেই চিন্তাভাবনা! যাই হোক, তাঁরা যে ভুল ছিলেন তা আমরা আজ সকলেই জানি। অতিপরিবাহিতার মতন এক উদীয়মান আশ্চর্য পদার্থের ধর্মের আবিষ্কারের কথা কেউ নিশ্চিত চিন্তাও করতে পারেননি, এমনকি ১৯১১ সালের আগেও। ১৯৮৬ সালের উচ্চ-তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতা ধর্মের আবিষ্কারই-বা কে অনুমান করতে পেরেছিলেন। মোদ্দা কথা কেউ যদি অনুমান করেন বিজ্ঞানের দিন শেষ হতে চলেছে তাহলে তার সেই অনুমানের উপর বেশি ভরসা না করাই ভালো।
১৯১৮ সালে এক জার্মান স্কুলশিক্ষক, তাঁর নাম অসওয়াল্ড স্পেংলার, দি ডেকলাইন অফ দি ওয়েস্ট নামে একটি বই প্রকাশ করেন। অনুমান করা যায় বিজ্ঞানের শেষ এই ধারণার প্রথম প্রকাশ এই ভাববাদী মানুষটিই করেছিলেন। তাঁর সেই বিশাল মাপের বইটিতে তিনি যুক্তি খাড়া করেছিলেন, বিজ্ঞানের বিকাশ আসলে একটি আবর্তনশীল ঘটনা। তিনি যুক্তি রেখেছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীরা, তাঁদের নিজেদের আবিষ্কারের ফলে, যত দাম্ভিক হয়ে উঠবেন, অন্যদের বিশ্বাসকে যত খাটো করতে শুরু করবেন, লক্ষণীয়ভাবে যখন ধর্মকে অবিশ্বাসের নজরে দেখবেন, সমাজ তখনই বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এবং বিজ্ঞানচিন্তাকে তত বর্জন করবে। শুধু তাই নয়, মানুষ, সমাজ আরও বেশি ধার্মিক হয়ে উঠবে। অসওয়াল্ড এ-ও অনুমান করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষে গিয়ে মানুষের বিজ্ঞানের প্রতি আর কোনো আস্থা তো থাকবেই না, পরিবর্তে অযৌক্তিকতার পুনরূত্থান শুরু হবে। যাই হোক, অসওয়াল্ড-এর বিজ্ঞান বিষয়ের যে ধারণা, তা নেহাতই যুক্তিহীন। বিজ্ঞানের আবিষ্কার কখনোই আবর্তনশীল একটি ঘটনা নয়। কেননা রসায়নবিদ্যায় পর্যায়-সারণি, মহাবিশ্ব যে ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, অতিপরিবাহিতা, ডি এন এ, এইসব একবারই আবিষ্কার করা যায়। ৫০০ বছর পরে আবার এগুলোকে নতুন করে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে বলা যায়, রিচার্ড ফাইনম্যান–যিনি ১৯৬৫ সালের নোবেলবিজয়ী পদার্থবিদ ছিলেন–কোথাও একটা বলেছিলেন, ঠিক এইরকম কিছু কথা। আমরা খুব ভাগ্যবান এমন একটা সময়ে আমরা বেঁচে আছি, এখনও আমরা আবিষ্কার করে চলেছি। এই আবিষ্কার অনেকটা আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের মতনই, যা একবারই আবিষ্কার করা যায়। এমন একটা সময় যখন আমরা প্রকৃতির মৌলিক নীতিগুলোকে আবিষ্কার করছি, এই দিন আর ভবিষ্যতে আসবে না। এই সময় অত্যন্ত রোমাঞ্চকর, এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর, কিন্তু এই রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি বেশিদিন থাকবে না। অবশ্যই আগামীদিন নিয়ে আসবে নতুন কিছু আগ্রহের বিষয়। তাতে থাকবে একধরনের ঘটমান বিষয়ের সঙ্গে অন্যধরনের ঘটমান বিষয়ের যোগসূত্র-থাকবে জীববিদ্যা, আরও অনেক কিছু, থাকবে নতুন অনুসন্ধান, থাকবে নতুন খোঁজ নতুন গ্রহের, কিন্তু আজকে আমরা যে জিনিস নিয়ে গবেষণা করছি, সেই জিনিস হয়তো আর থাকবে না। কিন্তু ফাইনম্যানের এই বাক্যগুলিকে খুঁটিয়ে পড়লে এটাই অনুধাবন করা যায় মানুষের জীবন যেমন থেমে থাকে না, ঠিক তেমনই বিজ্ঞানের অগ্রগতিও থেমে থাকে না। নতুন দিশা আসে, নতুন ধারণা আসে, নতুন যুক্তি আসে। পদার্থের নতুন ধর্ম আসে। কিন্তু তা রিডাকশনিজম মতবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কিনা সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
কোয়ান্টাম প্রোটেকটরেট (কোয়ান্টাম অভিভাবকত্ব)
Quantum Protectorate
এবারে আমরা আবার ফিরে আসি রিডাকশনিজম মতবাদের অন্যরকম কিছু কথায়।
অতিপরিবাহিতা পদার্থের একটি উদীয়মান বৈশিষ্ট্য। পরীক্ষাগারের একটি পরীক্ষালব্ধ ফল। এই ধর্মটি বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ অকাল্পনিক কিছু পদার্থে। বাস্তবে তা দেখা যায়, চোখের সামনে তাকে তুলে ধরা যায়, উপলব্ধি করা যায়, প্রতিস্থাপিত একটি ঘটনা। এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনে প্রয়োগও মজুত। বিশেষ কিছু পদার্থে, এক ডেলা পরিমাণ নিয়ে, তাপমাত্রা কমাতে থাকলে মানুষ পর্যবেক্ষণ করতে পারে, কীভাবে পদার্থের রোধ-শূন্য হয়ে যায়। মানে সেই পদার্থের মধ্যে কারেন্ট পাঠালে তা অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো শ্রোয়েডিংগারের গাণিতিক সমীকরণের সমাধান করে, বা সেই থিয়োরির মাধ্যমে পদার্থের সেই ধর্মকে ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা যায় না। আর সেখানেই তৈরি হয় সমস্যা, তাহলে আর কীসের থিয়োরি অফ এভরিথিং। তার মানে রিডাকশনিজম মতবাদও খাটে না। মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটমান বিষয় যেমন, গ্রহ, নিউক্লীয় বিস্ফোরণ, সূর্যের বিভিন্ন ঘটনা, পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন আইসোটোপের আধিক্য, এইসব বর্ণনা করতে চাইলে শ্রোয়েডিংগারের গাণিতিক সমীকরণের প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন মহাকর্ষ এবং পারমাণবিক মিথস্ক্রিয়া, এইসব সেখানে হাজির নেই। আসলে অতিপরিবাহিতার মতন পদার্থের উদীয়মান কিছু ধর্ম নির্ভর করে উচ্চতর বিন্যাস-নীতির উপর। এই প্রসঙ্গে ডেভিড পাইন্স এবং রবার্ট লগলিন নামে দুই পদার্থবিদ ‘কোয়ান্টাম প্রোটেকটরেট’ শব্দদুটির পরিবেশন করেন। বাংলায় বলা যায় কোয়ান্টাম অভিভাবকত্ব। মোদ্দা কথা একটি আশ্রিত রাজ্য যেমন পরিচালিত এবং সুরক্ষিত থাকে অন্য একটি রাজ্যের মাধ্যমে, ঠিক তেমনই পদার্থের উদীয়মান কিছু ধর্ম পরিচালিত এবং সুরক্ষিত থাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতিকে মেনে, তবে অনেকগুলো অণুর সম্মিলিত এবং সংগঠিত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে, যা দেয় পদার্থের একটি স্থিতিশীল দশা এবং যা পদার্থের একটি অণুর নির্দিষ্ট ধর্মের উপর শুধু নির্ভর করে না। যা পদার্থের মধ্যে অবস্থিত কিছু খাদের উপর নির্ভর করে না, যা পদার্থের আংশিক খুঁতের উপর নির্ভর করে না, যা আশপাশের তাপমাত্রার মৃদু ঝাঁকুনির উপরও নির্ভর করে না।
উচ্চতর সংগঠিত নীতি
(Higher Organised Principle)
পদার্থের অতিপরিবাহিতা এমন একটি ধর্ম, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কিছু নীতির উপর ভিত্তি করে ইলেকট্রনগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে। এমন একটি অবস্থা যেখানে দুটো ইলেকট্রন আবার সংযোজিতও থাকে। সেই সংযোজিত দুটি ইলেকট্রন আবার ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক অদ্ভুত নিয়মের ফলে সম্মিলিতভাবে কাজও করে। ইলেকট্রনের জোড়গুলি একত্রিতভাবে কাজ করেই এই অতিপরিবাহী হয়ে ওঠে। এখন যদি কেউ মনে করেন এক একটি নির্দিষ্ট অণু সতন্ত্রভাবে অতিপরিবাহী ধর্ম প্রদর্শন করবে, সে-গুড়ে বালি। তাহলে তখন আর অতিপরিবাহীর অস্তিত্বই থাকবে না। এটা একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এক-একটি অণু দিয়ে একটি পদার্থে তৈরি করা হলেও, এক ডেলা পদার্থ ১০২৩ অণু দিয়ে তৈরি হলেও, সেই পদার্থেরই যদি একটি অণুকে আলাদা করা যায়, সেক্ষেত্রে সে অতিপরিবাহী ধর্ম প্রদর্শন করবে না। কিন্তু সামগ্রিক পদার্থটি হয় যদিও অতিপরিবাহী। আসলে অতিপরিবাহীর মতন পদার্থের উদীয়মান বৈশিষ্ট্য কাজই করে সম্মিলিতভাবে। আমরা যখন গ্রামে অথবা শহরের কোনো একটা মেলায় যাই, যেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড়, সেখানে আমরা মানুষের কোলাহলের একটি সামগ্রিক শব্দ পাই বটে, কিন্তু কিছুই যেন পরিষ্কারভাবে শুনতে পাই না। একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে ভেসে আসে। প্রতিটি মানুষই নিজের নিজের স্থানে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে চলেন, বিভিন্ন স্বরে, বিভিন্ন বিষয়ে, বিজ্ঞানের ভাষায়, মানে বিভিন্ন কম্পাঙ্কে। তাই প্রতিটি কথা বা শব্দ আমরা না বুঝতে পারেলও সামগ্রিকভাবে তার একটা গড় বা নেপথ্য শব্ধ (background noise) আমাদের কাছে আসে। আর সেটাই বিরাট জনস্রোতের একটি সম্মিলিত আওয়াজ। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে, প্রতিটি মানুষ সেখানে ভিন্ন কম্পাঙ্কে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে চলেছেন। আর তাঁদের একে অন্যের সঙ্গে কোনো সম্মিলিত প্রচেষ্টাও নেই। তাই এটি একটি কোনো উচ্চতর সংগঠিত নীতি (higher organised principle) নয়। এবারে আর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, ইটালিয়ান সংগীতজ্ঞ, সুরকার এবং অর্কেস্ট্রেটর এনিও মরিকোনের একটি সিম্ফনি শুনতে গেলাম। আমরা জানি সেই মিউজিক ইভেন্টে অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র সম্মিলিতভাবে এক সুন্দর সুরের আবহ তৈরি করে। এটাই সমবেত সংগীতের বিশিষ্টতা। সেখানে একটি স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্র কী শব্দ পরিবেশন করছে, সেই বিস্তারিত তথ্যের দিকে আমাদের কিন্তু নজর থাকে না, সামগ্রিকভাবে বা সমবেত যে সুরটি আমাদের কানে আসে সেটাই গুরত্ব পায়। এটাকে বলা যেতে পারে উচ্চতর সংগঠিত নীতি (higher organised principle)। অতিপরিবাহিতা ঠিক একই রকমের একটা ঘটনা।
মূল কথা হলো ‘যত বেশি তত ভিন্ন’ এইভাবেও আধুনিক বিজ্ঞানকে দেখা যেতে পারে। মৌলিক, গভীর, প্রগাঢ় যে বিজ্ঞানের কথাই আমরা বলি না কেন, এই সব ক্ষেত্রেই শুধু অণু বা পরমাণুতেই আমাদের সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না। একথা অস্বীকার করার কারও স্পর্ধা নেই কিছু মৌলিক নীতি, সরল সমীকরণের মাধ্যমে পদার্থকে বা প্রকৃতিকে অনুধাবনের প্রচেষ্টা শুধু প্রশংসারই দাবি রাখে, এটা যেমন সত্যি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটাও ভাবতে হবে, বাস্তব বিশ্ব অনেক বেশি জটিল। সেখানে যেসমস্ত উদীয়মান ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা অনেক বেশি জটিল। পদার্থের অতিপরিবাহিতা, কঠিন পদার্থের চৌম্বকধর্ম এইরকম কিছু জটিল সমস্যা। শুধু কি তাই? মানুষের ইমোশন, মানুষের অনুভব, মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ, ক্যায়স, আবহাওয়া কতকিছুই এইসব জটিল উদীয়মান ঘটনার মধ্যে পড়ে। এইসব অনুধাবনের জন্যে প্রয়োজন উচ্চতর সংগঠিত নীতি। প্রয়োজন নতুন তীক্ষ্ণ, শানিত ধারণা। প্রয়োজন নতুন দৃষ্টি।
Comments