সাধারণত ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার সীমার মধ্যে পরিমাপ খুব একটা সমস্যার নয়। দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, তাপমাত্রা এ সবই আমরা নিখুঁতভাবে পরিমাপ করতে পারি। আমাদের প্রয়োজনে যতোটা হলে চলে আর কি। সেই পরিমাপের প্রশ্ন যখন অতীব ক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে চলে আসে বিষয়টি তখন আর এক থাকে না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক চারকোণা বা গোলাকার একটি বিস্কুট নেওয়া হল পরিমাপের জন্যে। অতি সহজেই সেই বিস্কুটের দৈর্ঘ, প্রস্থ এবং উচ্চতা কোনো স্কেলের সাহায্যে মেপে ফেলা যাবে। বলে দেওয়া যাবে কতো সেন্টিমিটার। বিস্কুটটিকে ভাঙতে শুরু করা হলে, বিস্কুটের টুকরো যতো ছোটো হবে, আমাদের পরিমাপ করা ততোই কঠিন হয়ে যাবে। প্রথমে স্কেল দিয়ে পরিমাপ করা ছিল যথেষ্ট। এরপরে লাগবে স্লাইড ক্যালিপার্স, এরও ক্ষুদ্র হলে, কোনো মাইক্রোস্কপের সাহায্য নিয়ে তার পরিমাপ করে যাবে। বিস্কুটের কণা যদি অতীব ক্ষুদ্র হয়, কয়েকটি পরমাণুতে গিয়ে ঠেকে, তখন পরিমাপের জন্যে আমাদের প্রয়োজন হবে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপ অথবা এটমিক ফরস মাইক্রোস্কপ। বিষয়টি ইতিমধ্যেই অনেক জটিল হয়ে গেল। এর থেকেও জটিল হবে যদি একটি ইলেকট্রনকে মাপার চেষ্টা করা হয়। সেখানে পরিমাপের পদ্ধতিতেই অনেক সীমাবদ্ধতা চলে আসবে। জটিলতা এমনই হবে, আমরা যদি ইলেকট্রনকে জানি সে কোথায় আছে, তবে নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না সে কি করছে। আবার যদি বলা যায় ইলেকট্রন কি করছে, সেক্ষেত্রে নিশ্চিত বলা যাবে না ইলেকট্রনটি কোথায় আছে। এটি হল কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ডের অত্যন্ত মজার একটি বিষয়। অর্ধেক তথ্য আমরা নিশ্চিতভাবে দিতে পারবো, বাকি অর্ধেক অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ন। ১৯২৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ ওয়েরনার হাইজেনবার্গ প্রথম কোয়ান্টাম তত্বের ধারণা দিলেন, এবং এর ঠিক দুই বছর পরে নিয়ে এলেন আনসারটিনিটি নীতি বা অনিশ্চয়তা নীতি। এই নীতির মূল ধারণা কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ডের পরিমাপের সীমাবদ্ধতা থাকছে। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের যথার্থতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এই অসাধারণ তত্ত্বের অন্যতম ভীতটি স্থাপিত হয়েছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষার মাধ্যমে কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল ধারণার কয়েক বছর আগেই।
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে স্পিনের ধর্মকে আরো গভীরে জানার জন্যে দুই জার্মান পদার্থবিদ অভিনব একটি পরীক্ষা চালনা করেন। যদিও সেই সময় স্পিনের ধারণা সবে মাত্র জন্ম নেবে নেবে করছে। ১৯২২ সালের ৭ থেকে ৮ ই ফেব্রুয়ারির রাতে অটো স্টার্ন এবং ওয়ালথেয়ার গেয়ারলাখ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন পদার্থের ক্ষুদ্র কণার এঙ্গোলার মোমেনটাম বা কৌণিক ভরবেগ যেদিক ইচ্ছে সেদিকে নির্দেশিত থাকে না। শুধুমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন এবং নির্দিষ্ট দিকেই সে আসীন থাকতে পারে। সেই দিক নির্দেশক পরিমাপকরণ ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যাকে সমর্থন করে না, এবং এই ধর্ম কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এককথায় বলা যায় স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ পরীক্ষা আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শুধুমাত্র ভিত্তিপ্রস্তরই স্থাপন করে নি, এরই সাথে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণার এক নতুন দিশাও দিয়েছিল।
স্টার্ন ছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত ম্যাক্স বর্নের একজন সহযোগী। স্টার্ন চিন্তা করেন যেহেতু ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কিছু কক্ষপথেই প্রদক্ষিণ করে, ইলেকট্রনকে একটি ক্ষুদ্র চুম্বকের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ইলেকট্রনগুলিকে যদি কোনো অসমজাতীয় চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয় তাহলে ইলেকট্রন অসম চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যে বল অনুভব করবে। অসম চৌম্বকক্ষেত্র বলতে বোঝানো হয়েছে স্থান পরিবর্তনের সাথে চৌম্বকক্ষেত্রের মান এক থাকবে না, তা ভিন্ন হবে। সহজ উপায় একটি চুম্বকের উত্তর- এবং দক্ষিণমেরুকে অসম আকৃতির প্রস্তুত করা হলে, সেখানে যে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হবে তা ঐ দুই মেরুর মাঝে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হবে। চৌম্বকক্ষেত্রের একটি গ্র্যাডিয়েন্ট থাকবে। স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ পরীক্ষার দুইজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে অনেকটা এইভাবে ভাগ করা যেতে পারে। অটো স্টার্ন এই পরীক্ষার ধারণা এবং নকশা দিয়েছিলেন, এবং ওয়ালথেয়ার গেয়ারলাখ সেই নকশাকে বাস্তবায়িত করেছেন। স্টার্ন ইউনিভার্সিটি অফ ব্রেসলাও থেকে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে পি এইছ ডি করেন, এবং আইনস্টাইনের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন প্রাগের চার্লস ইউনিভার্সিটিতে। এরপরে তিনি আইনস্টাইনের সাথে জুরিখে চলে যান। পরে আইনস্টাইন বার্লিনে কাইজার ওয়িলহেলম ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা হলেন, এবং স্টার্ন চলে গেলেন ফ্রাঙ্কফুর্টে ১৯১৯ সালে। কিছুদিন অবশ্য স্টার্ন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবেও কাজ করেন, ফ্রাঙ্কফুর্টে কর্মে যোগদান করার আগে। স্টার্ন একদিকে যেমন বিশেষজ্ঞ ছিলেন ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে আবার ঠিক অন্যদিকে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাতেও তাঁর দখল ছিলো অসামান্য। ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রাঙ্কফুর্টে ১৯১৯ সালে স্টার্ন অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন, যদিও সেটি স্থায়ী পদ ছিলো না, সেই সময় ম্যাক্স বর্ন ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা।
ওয়ালথেয়ার গেয়ারলাখ-এর সাথে স্টার্ন ১৯২০ সালে স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালে স্টার্ন পরীক্ষার ধারণা নিয়ে একাকী একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেটি ছিলো তাত্ত্বিক ধারণা এবং স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর। ওয়ালথেয়ার গেয়ারলাখ পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যায় ১৯১২ সালে পি এইছ ডি এর কাজ শেষ করেন, এবং ১৯২০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ফ্রাঙ্কফুর্টে সহকারী পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ হিসেবে যোগদান করেন। স্টার্ন যেখানে ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাবিভাগের সদস্য আর গেয়ারলাখ ছিলেন পরীক্ষামূলক পদার্থবিদ্যা বিভাগে কর্মরত। শেষমেশ তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এনে দিল এক যুগান্তকারী ধারণা। কোয়ান্টাম তত্ত্বের পরীক্ষামূলক ভিত্তি প্রস্তর তাঁদের পরীক্ষার মাধ্যমে স্থাপিত হল। পরীক্ষার জন্যে আবশ্যক যন্ত্রের মূল নকশা দিয়েছিলেন স্টার্ন, যন্ত্রের বিভিন্ন অংশগুলি নির্মাণে সহায়তা করেন এডলফ স্মিথ। ওয়ালথের গেয়ারলাখ যন্ত্রের সমস্ত অংশগুলিকে এক-জায়গায় করেন এবং পরীক্ষার জন্যে যন্ত্রটিকে যথাযথভাবে চালনা করেন। নীচের পরিকল্পিত নকশায় দেখানো হয়েছে পুরো যন্ত্রটিকে।
তাঁরা রূপার (সিলভার) অণু নিয়ে পরীক্ষার কাজ শুরু করেন। উনুনের উপর সিলভার উত্তপ্ত করা হলে উত্তপ্ত সিলভার গ্যাসীয় দশায় পরিবর্তিত হয়। সিলভারেরে বাষ্পকে সমান্তরালে রাখা কয়েকটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে পাঠালে, উত্তপ্ত সিলভার বাষ্পের একটি কলিমেটেড বীম তৈরি করা সম্ভব। কলিমেটেড বীম মানে আর কিছুই নয়, উত্তপ্ত সিলভার অণুগুলি এক অন্যের সাথে সমান্তরালে একই অভিমুখে চলতে পারে। যাতে এক অন্যের সাথে সংঘর্ষ এড়ানো যায়। এরপরে তৈরি হওয়া কলিমেটেড বীমকে অসম চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়। পরবর্তী ধাপে ছিলো ডিটেক্টর প্লেট, যেখানে চৌম্বকক্ষেত্রকে পেরিয়ে আসা উত্তপ্ত সিলভার পরমাণুগুলির আছড়ে পড়ার কথা। ডিটেক্টর প্লেটটি পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে বলা যাবে উত্তপ্ত সিলভার পরমাণুর উপর অসম চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব কী।
১৯২১ সালে গেয়ারলাখ তাঁদের তৈরি যন্ত্রের সাহায্যে যে পরীক্ষা চালনা করেন, ডিটেক্টর প্লেটে সিলভারের ছাপ তৈরি হল তা ঠিক, কিন্তু তার বিভাজন খুব একটা প্রকট ছিলো না। চৌম্বকক্ষেত্র থেকে ডিটেক্টর প্লেটের দূরত্ব খুব কম থাকার জন্য যদিও উত্তপ্ত সিলভার বাষ্প অসম চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে কলিমেটেড বীম থেকে বিভাজিত হয়েছিল সেটা ঠিক, তবু ডিটেক্টর প্লেট চৌম্বকক্ষেত্র থেকে খুব কাছে থাকায় সেই প্রভাব খালি চোখে বোঝা যায় নি। এরই সাথে কলিমেটেড বীম যা কয়েকটি গোলাকার ছিদ্রের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল, বীমের তীব্রতাও যথেষ্ট ছিলো না। তাই আবশ্যক ছিলো যন্ত্রের অনেক আপডেটের। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সেই যন্ত্রের গঠনের বেশ কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব হল। অবশেষে সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই ডিটেক্টর প্লেটে সিলভারের যে প্যাটার্ন দেখা গেল, তা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিল সিলভারের বীম উপস্থিত চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যে বিভাজিত হয়ে গিয়েছে।
এখানে প্রথম যে বিষয়টি লক্ষ্য করার তা হল ডিটেক্টর প্লেটে বিমের স্পট একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নেই আছে। তা না হয়েছে থ্যাবড়া, না হয়েছে গোলাকার। ঘটনাটি দেখে মনে হয় যেন সিলভারের কলিমেটেড বীম দুইটি দলে ভাগ হয়ে গেছে। প্রথমে তারা একই দলে ছিলো, যদিও তাদের মত হয়ত ছিলো ভিন্ন, কিন্তু তাও তারা একই সাথে ছিলো। যেই অসম চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব তাদের উপর পড়ল, অমনি তারা তাদের নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তাদের ভিন্ন পথ তারা বাছাই করে নিল।
এ গেল প্রথম সাধারণ পর্যবেক্ষণ এবং তার থেকে করা আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণের আসল গুরুত্বটি কোথায়। কেনই বা বিজ্ঞানী মহল এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে এতো মুগ্ধ হলেন। তার মূল কারণ ছিলো যদি ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার কথা ভাবা হতো, সেক্ষেত্রে এই সিলভার পরমাণুর যে ছাপ ডিটেক্টর স্লিটে তৈরি হতো, তা দেখতে কেমন হতো! তা দেখতে হতো অনেকটা ঝাপসা, অনেকটা জায়গা নিয়ে একটি স্পট। তাহলে কী ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার সাহায্যে এই পরীক্ষার পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। শুধু তাই নয়, যদি সিলভার পরমাণু নিয়ে এই পরীক্ষা না চালিয়ে অন্য কোনো পরমাণু নিয়ে চালানো হয়, তাহলে বিষয়টির ফলাফল কী রকম হবে। এইসব বিভিন্ন প্রশ্ন সকলের সামনে এলো। এখানে যদি সমান মানের চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয় তাহলে প্রতিটি পরমাণু চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যে একটি টর্ক অনুভব করবে, কিন্তু কোনো বল অনুভব করবে না যা পরমাণুগুলিকে বেঁকে যেতে সাহায্য করবে। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যার যদি এখানে প্রযোজ্য হতো তাহলে ডিটেক্টিং প্লেটে সিলভার পরমাণুগুলি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। কিন্তু পরিবর্তে যা ঘটল কিছু পরমাণু চুম্বকক্ষেত্রের জন্যে বেঁকে উপরে গিয়ে বসলো এবং বাকিরা বেঁকে আবার নীচে গিয়ে বসলো।
পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছে এই বিশেষ ঘটনাটি ঘটেছে শুধুমাত্র সিলভার পরমাণুর জন্যে নয়। ১৯২২ সালের বেশ কিছু বছর বাদে, হাইড্রোজেন পরমাণু নিয়ে এই একই পরীক্ষা চালনা করে দেখা গেছে, পর্যবেক্ষণ একইরকম, অর্থাৎ ডিটেক্টিং প্লেটে বীম ঠিক দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। সিলভার নিয়ে এই পরীক্ষাটি করার সুবিধা হল, সিলভার পরমাণুর সবথেকে বাইরের কক্ষপথে যে ইলেকট্রন আছে, সেই আসলে এই ঘটনার জন্যে দায়ী। ঠিক একই ভাবে হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রেও, তাতে উপস্থিত একটি মাত্র ইলেকট্রন এই ঘটনাটি ঘটায়। মোদ্দা কথা, ইলেকট্রনের একটি বিশেষ ধর্ম আছে, এবং সেই ধর্ম ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সেই ধর্মের জন্যে ইলেকট্রন চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট ভাবেই বিস্তৃত হতে পারে। স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষার মূলনীতি অনুযায়ী শুধুমাত্র ইলেকট্রনের বীম দিয়েও এই পরীক্ষা চালনা করা সম্ভব। তবে সেখানে আসে অন্য জটিলতা। সে আলোচনা আপাতত এখানে করা হল না। এই পরীক্ষার যে ফলাফল, তার ব্যাখ্যা কিন্তু স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ প্রাথমিক স্তরে দিতে পারেন নি। শুধু এই বিষয়টি পরিষ্কার ছিলো ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা দিয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করা আদেও সম্ভব নয়। সেই সময় যে তাত্ত্বিক ধারণা মজুত ছিলো, সেখানে এই দ্বন্দ্ব ছিলো যে সিলভার পরমাণুর বীম বিভক্ত হয়ে দুটি অথবা তিনটি বিমে ভাগ হয়ে যাবে। সমারফেলডের মতবাদ অনুযায়ী বীমটি বিভক্ত হয়ে তিনটি ভাগে ভাগ হবে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে ট্রিপলেট স্প্লিটিং। একটি রেখা থাকবে মাঝে এবং সেই রেখার দুই পাশে থাকবে আলাদা ভাবে আরো দুইটি। বোর অন্যদিকে অনুমান করলেন, না এক্ষেত্রে ডব্লেট স্প্লিটিংই হবে, একটি রেখা বিভক্ত হয়ে দুটি রেখায় ভাগ হবে। মাঝে কোনো রেখা থাকবে না। পরীক্ষার ফলাফল জানালো যে বোরের মতবাদই সঠিক ছিল। স্টার্ন-গেয়ারলাখ তাঁদের পরীক্ষা থেকে এটা ব্যাখ্যা করতে পারেন নি, যে প্লেটে যে দুটি রেখা ফুটে উঠেছিল, তা সিলভার পরমাণুর বাইরের কক্ষপথে উপস্থিত ইলেকট্রনের জন্যে। স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষার সাফল্যের বহু বছর পরেও, স্টার্ন আংশিক খটকা প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের পরীক্ষার ফলাফল এবং এর অন্তর্নিহিত পদার্থবিদ্যার নীতি নিয়ে। ১৯৬১ সালের একটি সাক্ষাৎকারে স্টার্ন বলেন। But with the outcome of the experiment, I really did not understand anything... It was absolutely unintelligible. But this is very clear since you need not only the new quantum theory but also the magnetic electron. These two things that weren’t there at the time. I was totally confused and did not know at all what to make of it. I still have objections against the beauty of quantum mechanics. But it is a correct theory. বর্তমানে স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষার ফলাফল যথাযথভাবে বর্ণনা করা সম্ভব। স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ উভয়েই এই কাজের স্বীকৃতি বিভিন্নভাবে পেয়েছেন। স্টার্ন বহুবার তাঁর কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন। গত শতাব্দীর ৩০ এর দশকে তাঁকে অবশ্য বাধ্য হয়েই জার্মানি ছাড়তে হয়। কারণ তিনি ছিলেন একজন ইহুদী। এরপরে বাকি জীবনটা তাঁর আমেরিকাতেই কাটান। অন্যদিকে গেয়ারলাখ জার্মানিতেই থেকে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেখানে স্টার্ন আমেরিকার পারমাণবিক বোমা প্রকল্পে যোগ দিয়েছিলেন, অন্যদিকে গেয়ারলাখ ছিলেন জার্মানির পারমাণবিক গবেষণা প্রকল্পের মাথায়।
স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষা থেকে একটি ধারণা পরিষ্কার হল ইলেকট্রনের স্পিন যা খুশি তাই হতে পারে না। স্পিনের সুনির্দিষ্ট কিছু মানই থাকতে পারে। হয় সে হবে স্পিন-আপ অথবা স্পিন-ডাউন। এ ছাড়া আর অন্য কোনো সম্ভাবনা ইলেকট্রনের নেই। উপস্থিত চৌম্বকক্ষেত্র তা একেবারে নির্দিষ্ট করে দিল। স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষার ব্যবহার করা চুম্বকের উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু যদি উল্টে দেওয়া যায়, তাহলেও দেখা যায় বীম বিভক্ত হয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এবং বিভক্ত রেখার তীব্রতাও অপরিবর্তিত থাকবে। পরীক্ষাটি থেকে এটা বোঝারও উপায় নেই কোন ইলেকট্রন নীচের দিকে যাবে, এবং কোন ইলেকট্রন উপরের দিকে থাকবে। শুধু পরীক্ষা থেকে এটাই বলা যাবে যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যতো ইলেকট্রনই যাক না কেন, তাদের অর্ধেক যাবে নীচে এবং বাকি অর্ধেক যাবে উপরে। কিন্তু কোন ইলেকট্রন উপরে যাবে এবং কোনটি নীচে যাবে সেই বিষয়ে নিশ্চিত কিছুই বলা যাবে না। এখান থেকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক অসাধারণ বিষয়ও প্রমাণিত হল।
লেখাটি শেষ করা যায় এটা বলে, ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯২২ সালে ওয়ালথেয়ার গেয়ারলাখ এবং অটো স্টার্ন একটি অসাধারণ পরীক্ষা পরিচলানা করেন, যা পদার্থবিদ্যার বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। আধুনিক বিজ্ঞান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে এই পরীক্ষার আছে অনবদ্য অবদান। আজকের জ্ঞানের আলোকে বিচার করলে নিঃসন্দেহে বলা যায় স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ এমন একটি মৌল পরীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন যা কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ হাতে কলমে দিয়েছিল। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বিকশিত হওয়ার প্রায় তিন বছর আগেই এই পরীক্ষাটি চালনা করা হয়। পরীক্ষাটি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার এমন এক কাঠামো তৈরি করলো যা সবাইকে ভাবতে বাধ্য করলো কোয়ান্টাম ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্যাল ওয়ার্ল্ড থেকে অনেকটাই আলাদা। স্টার্ন-গেয়ারলাখ পরীক্ষা প্রমাণ করলো পারমাণবিক জগতের পরিমাণ পদ্ধতিতে, যাকে পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় কোয়ান্টাইজেশন, অনেক তাত্ত্বিক অনুমান বাস্তবেই যথার্থ। স্টার্ন এবং গেয়ারলাখ পরীক্ষার আছে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব। এই পরীক্ষা খুলে দিয়েছিল নতুন দিগন্ত একটি বিচ্ছিন্ন পরমাণুর কী কী বৈশিষ্ট্য হতে পারে যখন সেই পরমাণু শূন্য স্থানের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে। স্টার্ন এবং গেয়ারলাখের আগে, কেউ স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন একটি পরমাণু নিয়ে সফল গবেষণায় সক্ষম ছিলেন না। শুধু তাই নয় স্টার্ন এবং গেয়ারলাখের পরীক্ষা পথ প্রদর্শক ছিলো পারমাণবিক এবং আণবিক পদার্থবিদ্যার। আজ তাঁদের কেউই জীবিত নেই। ১০০ বছর আগের তাঁদের অসাধারণ কাজের সম্মান দেওয়ার জন্যে ফ্রাঙ্কফুর্টে তাঁদের পরীক্ষা পরিচালনার স্থানটিকে বিজ্ঞানচর্চার একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে আজ বেঁছে নেওয়া হয়েছে।
ছবি স্টার্নেরব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। বামদিকে প্লেটে বীমের প্যাটার্ন চৌম্বকক্ষেত্রের অনুপস্থিতিতে এবং ডানদিকে চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে ডিটেকটর প্লেটে উৎপন্ন হওয়া প্যাটার্ন।
Comments