প্রশ্ন করা মানুষের সহজাত ধর্ম। প্রথার বাইরে প্রশ্ন করা তা আরও বেশি কাম্য। যেমন প্রথার বাইরে চিন্তা করা আবশ্যক, ঠিক তেমনই প্রথার বাইরে ভাবনাও আবশ্যক। প্রথার বাইরে না ভাবলে, প্রথার বাইরে না চলতে পারলে সমাজ বদলায় না। মানুষের সামগ্রিক উন্নতি হয় না। জীবন হয়ে যায় স্থবির, সেখানে থাকে না গতি। আবার একথাও সত্যি, প্রথার বাইরে যাঁরা ভেবেছেন, প্রথার বাইরে যাঁরা পদক্ষেপ নিয়েছেন, প্রথার বাইরে যাঁরা কথা বলেছেন তাঁরা প্রাথমিক-স্তরে মানুষের থেকে বিতাড়িতই হয়েছেন। তবে তাঁরা কিন্তু হেরে যাননি। মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই প্রশ্ন করে এসেছে। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থেকেছে। প্রশ্ন করেছে নিজের স্বার্থে, প্রশ্ন করেছে অন্যের স্বার্থে। সেই প্রশ্নই মানুষকে দিয়েছে জ্ঞানের আলো, দিয়েছে নতুন দিশা, দিয়েছে অনেক সৃষ্টি। কিন্তু এমন কিছু প্রশ্ন মানুষ করে এসেছে যার উৎপত্তি ছিল প্রাথমিক-স্তরে সেই ভয় থেকে। যে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মানুষ মনে করত একমাত্র ধর্মই দিতে পারে। তাই মানুষ সেই ধর্মেরই দ্বারস্থ হয়ে এসেছে। সেই প্রশ্নগুলি কী রকম! যেমন, আমি কে! আমি কোথা থেকেই-বা এসেছি! কোথায় সবকিছুর শুরু, ইত্যাদি। একটা সময় ছিল মানুষ ভয় পেয়েছে প্রকৃতিকে, ভয় পেয়েছে প্রকৃতির রোষকে।মানুষ প্রশ্ন করেছে বিদ্যুৎ কেন চমকায়! কেন ঝড়বৃষ্টি হয়। মানুষ প্রশ্ন করেছে কেন সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ হয়।সূর্য কেন একদিকে উদিত হয়, অন্যদিকে অস্ত যায়! মানুষ কেন অসুস্থ হয়! কেন মানুষের জন্মহয়! কেনই-বা মৃত্যু আসে! কেন সন্তানরা তাঁদের পিতা-মাতার মতনই দেখতে হয়! জীবন কেন এত জটিল! ধর্মের দ্বারস্থ হওয়াতে, মানুষের কাছে সেই উত্তরগুলি ছিল অনেক সহজ। জটিলতায় না গিয়ে যদি ধরে নেওয়া যায় কোনো ধর্ম, কোনো ভগবান এই সবের জন্যে দায়ী, এই সবের জন্যে পর্দার আড়ালে, যাকে দেখা যায় না, অথচ কল্পনা করা যায়, আবার কোনো ক্ষেত্রে দেখাওযায়, এই রকমই কিছু একটা শক্তি সবকিছুর পিছনে, তাহলেই তো কেল্লা ফতে। সেটাই তো সহজ উত্তর। মাথা-ব্যথার ঝামেলা নেই, যুক্তি খাড়া করার ঝামেলা নেই, বিশ্লেষণ করার কোনো ঝামেলা নেই। মানুষ যুগ যুগ ধরে সেইভাবে সবকিছু মেনেও নিয়েছে। আজও অনেকে এইসব মেনে নেয়। এর পিছনে কারণ! হয় তারা বিজ্ঞান বোঝেনা, অথবা বুঝতে চায় না, অথবা বিজ্ঞানসম্মত উপায়েতা বোঝার কোনো আগ্রহ তাদের নেই। আর আগ্রহ যখন নেই তখন সেই বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করবার মতন সময়ও ওদের নেই। তা বলে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীরা কিন্তু থেমে থাকেননি, চুপ করে ঘরে বসে থাকেন নি। তাঁদের চেষ্টা স্থবির হয়ে যায়নি। সময়ের সঙ্গে এইসমস্ত প্রশ্নের উত্তর ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা দিয়ে এসেছেন।বিদ্যুৎ কেন চমকায় সেই উত্তর আমরা আজকে জানি। বৃষ্টি কেন হয় সেই উত্তরও আমরা জানি। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ কেনহয় সেই উত্তর আজ আমাদের আর অজানা নয়। বিজ্ঞান যথাযথভাবে সেইসব প্রশ্নের উত্তর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে এসেছে। আরও বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর, যা মানুষ ভাবত বিজ্ঞান কোনোদিনই দিতে পারবে না, তাও সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে দিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎকে দেখা যায় না, শুধুমাত্র কৃতবিদ্য অনুমান করা যায়। সেই অনুমান থেকে এবং অতীতের বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সফলতা এবং ধারাবাহিকতা বিচার বিবেচনা করলে এই ভরসাই করা যায় আগামীদিনে বিজ্ঞান শুধু আশার আলোই দেখাবে।
এই বিষয়ে কি বলেছেন পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং -
কিছু যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানী এবং মননশীল মানুষের কাছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী পদার্থবিদ ফিলিপ এন্ডারসন এবংজনপ্রিয় স্টিফেন হকিং–এঁদের মতে (এঁরা আর আমাদের মধ্যে নেই) ভগবান বলে এই মহাবিশ্বে কিছুই নেই। সমস্তকিছুই এই মহাবিশ্বে যুক্তি এবং তর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করাযায়, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। স্বর্গ, নরক এইসমস্ত ধারণারও কোনো অর্থ নেই। মানুষ জীবন হারালে তার অস্তিত্ব শেষ।হয় সে মাটিতে মিশে যায় অথবা ধূলিকণায় পরিণত হয়।এর বাইরে আর কিছুই নয়। এই বিশ্বে আমরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারি।আমরা স্বাধীনভাবে বিশ্বাসও করতে পারি। সেই অধিকার সকলের আছে। তাই সেই স্বাধীন চিন্তায় কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকাই কাম্য। আবার সেই স্বাধীন বিশ্বাসেও কোনো বল প্রয়োগ করে অন্য একটা বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া তাও অন্যায়, তাও অপরাধ। সেই স্বাধীন বিশ্বাসের উপর ভরসা করে কেউ যদি পরলোক, স্বর্গ এবং নরক নিয়ে ভাবতে থাকেন, সেই বিশ্বাসে আঘাত হানা হয়তো খুব ফলপ্রদ একটি সিদ্ধান্ত হবে না। তবে বিজ্ঞানের যুক্তিতে স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব নিয়ে যে যথাযথ প্রামাণিক তথ্যের অভাব আছে সেটা বলা যায়। কিন্তু এক অর্থে মানুষ তার জীবনাবসানের পরেও বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে তার কর্মে। বেঁচে থাকে মানুষের মধ্যেতার অবদানকে কেন্দ্র করে, তার সৃষ্টির মাধ্যমে। মানুষ বেঁচে থাকে তার প্রজন্মে যে জিন স্থানান্তরিত হয় তার সন্তানদের মধ্যে,তাতে।বেঁচে থাকে তার আদর্শে। বেঁচে থাকে তার শিল্প-কুশলীতে, বেঁচে থাকে তার সাহিত্যে, তার কবিতায়, তার উপন্যাসে, তার গানে, তার আবিষ্কারে। তারা বেঁচে থাকে মানুষের চিন্তায়।তারা বেঁচে থাকে মানুষের ভাবনায়।তারা বেঁচে থাকে মানুষের অন্তরে।
যে প্রশ্নটি অনেকেই করে থাকেন ঠাকুর বা ভগবান কি এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা? আসলে এই প্রশ্নটারই হয়তো কোনো মানে হয় না। আমরা যদি বিগ-ব্যাং থিয়োরিকে মেনে নিই। বিগ-ব্যাংঘটার আগে সময় ব্যাপারটাই তো ছিল না। যদি অন্য কিছু মতবাদও আছে, সেই তর্কে আপাতত যেতে চাই না। আমরা সময়কে শুধু এগোতেই দেখি। কখনই পিছাতে দেখি না। এখন সময় ব্যাপারটিই যদি স্থির থাকে, তার যদি এগোনো এবং পিছানো এই সবের গল্পই না থাকে, যদি তার কোনো অস্তিত্বই না থাকে,তাহলে ভগবান বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার নিশ্চিত ভাবে কোনো সময়ই ছিল না এই বিশ্বকে তৈরি করার। তাই এই প্রশ্নেরই হয়তো কোনো মানে হয় না। আসলে দর্শনকে বিভিন্ন ভাবে মানুষ দেখেন। এক ধরনের দর্শন যা কিছু মতবাদ, কিছু ধারণা, যা অঙ্কের সমীকরণ দিয়ে অতীব সূক্ষ্মতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা যায়।আর একধরনের দর্শন যাতে কোনো অঙ্কের সমীকরণ থাকে না, শুধু থাকে কিছু যুক্তি। বহুযুগ, বহু শতাব্দী ধরে বেশকিছু মানুষ মনে করে এসেছেন যে সমস্ত মানুষ বিকলাঙ্গ, অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ তারা আসলে ভগবানের একপ্রকার অভিশাপের ফসল। অনেক সময়ে অনেককেই কারণে অকারণে আমরা বলতে শুনেছি: এ হলো পাপের ফল অথবা পাপ ছাড়েনা বাপেরে। জার্মানিতে আমার এক অত্যন্ত পরিচিত সৎ, নিষ্ঠাবান, এককথায় ভালোমানুষ, অত্যন্ত ধার্মিক সেই ভদ্রলোক। মতলবি, ধান্দাবাজ এই শব্দগুলি ওঁর সঙ্গে একেবারেই চলেনা।সেই ধার্মিক মানুষটির তিনটি সন্তান জন্মাল। তাদের মধ্যে একজন হলো বিকলাঙ্গ। কিন্তু এখানে কীসের যুক্তি। কী তার অন্যায়, কী তার পাপ।
কার্য-কারণের উপরই সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে-
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে দেখলেএটা পরিষ্কার হয়ে যাবে এই ধরনের বাক্যের অথবা শব্দের কোনো মানেই হয় না। কিন্তু তবুও মানুষ বলে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় মানুষ এইসব কেন বলে? বলার আগে সে কী ভাবে? সে কী চিন্তা করে,কেন এই কথাটি বললাম? অধিকাংশ মানুষ চিন্তা বা ভাবনা না-করেই আবেগেই হয়তো বলেন, আর যাঁরা আবেগবশত বলেন না, তাঁরা ধরে নেন কোনো-একটা-কিছুর কারণে এই ফল।
মানে কার্য-কারণের উপরই সব কিছু দাঁড়িয়ে আছে। কারণের যথার্থতা প্রমাণ করা যায় কোন যুক্তিতে। কিন্তু যারা প্রকৃতই বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে তারা বলবে এই বিশ্বের সমস্ত কিছুই ঘটে নির্দিষ্ট কিছু সূত্র মেনে। যারা প্রকৃতির ওই বিশেষ কিছু নীতি বুঝতে পারে তাদের কাছে সমস্ত প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর মজুত থাকে। আসলে প্রকৃত বিজ্ঞানীদের কাজই হলো সেই নির্দিষ্ট নীতি গুলোকে খুঁজে বার করা, তার অন্বেষণ করা।
যে সব প্রশ্নের উত্তর এখনও মানুষ পায়নি সেই সব উত্তর যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে, তত্ত্বের মাধ্যমে একদিন ঠিকই মানুষের সামনে হাজির হবে। সেই আশাই করা যায়। তাতে কিছু বাহ্যুল্যতা বা অতিরেক নেই।
কী বললেন অ্যারিস্টার্কাস অফ সামোস-
বর্তমানে আমরা সবাই জানি সূর্যগ্রহণ কী এবং চন্দ্রগ্রহণই-বা কী। আমরা জানি আমাদের সৌরমণ্ডলে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র আর একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ক্রমাগত ঘুরে চলেছে। চন্দ্র যখন সূর্য এবং পৃথিবীর ঠিক মাঝ খানে এসে উপস্থিত হয়, মানে একই সরল রেখায় আসে, তখন আমরা সূর্যকে কিছু সময়ের জন্যে দেখতে পাই না, আমরা তাকে বলি সূর্যগ্রহণ। আবার ঠিক যখন পৃথিবী সূর্য এবং চন্দ্রের মাঝখানে এসে উপস্থিত হয়, তখন পৃথিবীর ছায়া সূর্যকে ঢেকে দেয়, আমরা তাকে বলি চন্দ্রগ্রহণ। এই ঘটনা ঘটে চলেছে প্রায় ৫০০ কোটি বছর ধরে। পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের উপস্থিতি প্রায় ২লক্ষ বছর আগে থেকে। কিন্তু প্রকৃতির এই সুন্দর নিয়মটির কথা প্রথম যে মানুষটি অনুধাবন করলেন তিনি এক দার্শনিক অ্যারিস্টার্কাস অফ সামোস, মাত্রপ্রায় ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। শুধু তাই নয়, তিনিএ-ওঅনুধাবন করে ছিলেন সূর্যই একমাত্র নক্ষত্র নয় এই মহাবিশ্বে, আছে আরও অনেক নক্ষত্র। কী অসাধারণ ছিল তাঁর উপলব্ধি। তা-ও সেই ৩০০খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে। তাঁর সেই উপলব্ধিকে কিন্তু অনেক মানুষই সেই সময় অনুমোদন করেননি। ভাবতে অবাক লাগে, এই পৃথিবীতে আজও কিছু মানুষ সেই ধারণা কে অনুমোদন করেন না। ভাবতে অনেকের অবাক লাগবে ২০০১ সালে দাঁড়িয়েও কেউ জিওসেন্ট্রিক মডেলের ধারণাতে বিশ্বাস করতে পারেন। এখানে জিওসেন্ট্রিক মডেল বলতে বোঝায় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যের প্রতিদিন একবার প্রদক্ষিণ করা। চন্দ্রও পৃথিবীকে একদিনে একবার প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবী সেই মডেলে নিজের অবস্থানে স্থির। তার কোনো গতিশীলতা নেই। অন্যান্য নক্ষত্ররাও নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বহুকাল যাবৎ মানুষের বিশ্বাস ছিল এই বিশ্বের কেন্দ্রে আছে মানুষ
বহুকাল যাবৎ মানুষের বিশ্বাস ছিল এই বিশ্বের কেন্দ্রে আছে মানুষ। মানুষের জন্যেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। মানুষের জন্যেই পৃথিবীর অন্যান্য সব জীবের অস্তিত্ব। মানুষের জন্যেই আছে অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র। একথা আমরা একটু আগেই বলেছি,আজ থেকে প্রায় ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রথম সেই ধারণার বাইরে অন্য ধারণার উপলব্ধি যে মানুষ করতে পেরেছিলেন তিনিই অ্যারিস্টার্কাস অফ সামোস। এর পরে কত সময় বয়ে গিয়েছে। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে নিকোলাস কোপার্নিকাস গণনার মাধ্যমে প্রমাণ করলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। পৃথিবী শুধু একা নয়, সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে আরও বেশ কয়েকটি গ্রহ। দার্শনিক অ্যারিস্টার্কাস সেই ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেই অনুধাবন করেছিলেন সৌরমণ্ডলের বাইরে যে নক্ষত্র গুলো রাত্রে মিটমিট করে আলো দেয় ওই সব তারা গুলো স্বর্গ,এটা ধরে নেওয়ার কোনো মানে নেই। ওই গুলোও এক একটি সূর্যের মতনই এক-একটা নক্ষত্র। শুধু তাদের অবস্থান পৃথিবী থেকে বহু দূরে। সত্যি, কী অসাধারণ ছিল তাঁর উপলব্ধি। মোদ্দাকথা, যাঁরা বলে থাকেন আকাশটি হলো স্বর্গ, আসলে তাঁদের জন্যে সহজ উত্তরটি হলো আকাশ হলো শূন্য, আর সেখানে রয়েছে অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু–এইসব। এই সব পদার্থ কিছু নির্দিষ্ট নীতি এবং তত্ত্ব মেনে চলে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, এই বিশ্ব আসলে একটি যন্ত্রেরই সমতুল্য। একটি যন্ত্র যেমন কিছু নিয়ম মেনেই চলে, সেই যন্ত্রের অংশগুলির আছে কিছু ধর্ম, সেই যন্ত্রটি আবার শাসনাধীন কিছু সূত্রের। মানুষের মস্তিষ্ক সেই নীতিগুলোকে জানে। তবে সে সমস্ত নীতিগুলো আমরা এখনও জেনে বুঝে উঠতে পারিনা, তাই আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়, চিন্তার রসদ জোগায়। সেখানে উত্তর খুঁজে না পেলেই আমরা অদৃশ্য শক্তির কথা ধরে নিই,তা নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি।
কী দিয়ে মহাবিশ্ব তৈরি!
এই মহাবিশ্ব তিনটি জিনিস দিয়ে তৈরি। প্রথমটি হলো ম্যাটার মানে বস্তু বা পদার্থ, মানে যা-কিছু সব আমরা দেখতে পাই: মানুষ, পশু, পৃথিবী, নক্ষত্র – এইসব। এর পরে আসে শক্তি। শক্তি কী তা আমরা অনুভব করতে পারি। প্রখর গ্রীষ্ম কালে সূর্যের সামনে দাঁড়ালে তা হাড়ে-হাড়েটের পাই। শক্তি থেকেই আমাদের ঘরে জল গরম করি। রাতে বিজলিবাতি জ্বলে, মোটর গাড়ি চলে, জাহাজ চলে, উড়ো জাহাজ চলে। এসব ই শক্তি, শুধু বিভিন্ন রূপান্তর মাত্র। এর পরে আছে স্পেস, মানে আমাদের চারপাশে যে শূন্যতা। অর্থাৎ যেখানে এইসব ম্যাটার বা পদার্থ থাকে। এখানে অবশ্য আইন স্টাইনের মতকে এনে বলতে পারি শক্তি এবং পদার্থ একে অন্যের রূপান্তর। তার মানে যেটা দাঁড়াল, এই মহাবিশ্ব শুধুমাত্র শক্তি এবং শূন্যতা দিয়েই গড়া। প্রশ্ন এখানেই, এর মধ্যে ভগবান কোথা থেকে এল! আসলে যা ঘটে আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাতে। আমরা সমস্ত কিছু, যা দেখি চারদিকে। তা কারণ আর ফলাফল এই দুটি শব্দের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত তাই আমরা ধরে নিই। আমরা সেভাবে ই অভ্যস্ত। আমাদের চিন্তা ভাবনা যুক্তি সেখানেই থাকে সীমাবদ্ধ। আমাদের সেভাবে ই শেখানো হয়। কী রকম ব্যাপারটা? একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। যখন কোথাও আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু ধোঁয়া দেখি, আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলি নিশ্চয়ই কোথাও আগুন জ্বলেছে। এখানে আগুন হলো কারণ আর ধোঁয়া হলো ফল। এবারে প্রশ্ন আসবে আচ্ছা আগুন কী করে জ্বলল? তখন হয়ে গেল আগুন একটি ফল। অর্থাৎ এর পিছনে নিশ্চয় আছে আর একটি কারণ। আমরা বর্ষা কালে দেখি প্রচুর বৃষ্টির ফলে খাল-বিল পুকুর সব জলে একে বারে ভর্তি হয়ে ওঠে। বৃষ্টি কী করে হয়! উত্তর,মেঘ থেকে। মেঘ কী করে জমে! যখন সূর্যের তাপে বছরের বিভিন্ন সময়ে–মূলত গ্রীষ্মকালে–সেইখাল-বিল পুকুরের সব জল বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে উঠে যায়। এর জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি আসে সূর্য থেকে। সূর্যে সেই শক্তি কী করে আসে। সূর্যের মধ্যে চলে এক অদ্ভুত রাসায়নিক বিক্রিয়া। হাইড্রোজেন পরমাণু এ কী ভূত হয়ে তৈরি হয় হিলিয়াম আর তাতেই এইশক্তির উৎস। এখন প্রশ্ন হলো সেই হাইড্রোজেন পরমাণু কোথা থেকেই - বা এল! মানে প্রোটন কোথা থেকে এল। সেখানেই সাধারণত যাঁরা তার্কিক যুক্তি বাদী ধার্মিক, আস্তিক, এবং আস্তিক দার্শনিক, তাঁরা আটকে যান অথবা অন্য যুক্তি দিতে চান। আসলে এটাই হলো ভগবানের সৃষ্টি। মানে আমাদের এই জীবনটিকারণ এবং ফলাফল এই দুটিতেই আটকে আছে এবং থাকে। যখনই কোনো ফলের কারণ বিজ্ঞান দিতে পারেনা, তখনই যাঁরা ধর্মান্ধ বা ভগবানে প্রগাঢ় বিশ্বাসী তাঁদের জাঁকিয়ে বসার পালা। এই প্রশ্নটাই এঁরা যুক্তিবাদীদের বিপক্ষে করে এসেছেন, কে সৃষ্টি করল এই মহাবিশ্ব। তাহলে নিশ্চয়ই এই মহাবিশ্ব ভগবানেরই সৃষ্টি। মানে শুরুটা। মানে কারণ কে! উত্তর,সেই ভগবান।
বিজ্ঞান এবং ধর্মের কথা নিয়ে আলোচনায় বসলে এই প্রশ্ন আসতেই পারে,আধুনিক বিজ্ঞানের প্রবর্তক যেমন আইজ্যাক নিউটন, ফ্রান্সিস বেকন, গটফ্রিড লেইবনিজ, রবার্ট বয়েল অথবা রেনে ডেসকারতেসের মতন বিজ্ঞানীরা কি শুধু ধর্মের বিশ্বাসকে খাটো করার জন্যেই মৌলিক নীতিগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন, কিছু সমীকরণ সৃষ্টি করেছিলেন? অঙ্কের ভাষায় প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন?কোনো জটিল যুক্তি ছাড়াই হয়তো এটা বলা যায় না। ১৬৩০ সালে ডেসকারতেস একজন ক্যাথলিক থিয়োলিজিয়ানকে লিখেছিলেন–ভগবান ই সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতির এই অঙ্কের নীতিগুলোকে,ঠিক যেমন করে মহারাজা তৈরি করেন বিভিন্ন নীতি তাঁর রাজ্যের জন্যে। রাজা চাইলেই যেমন রাজ্যশাসনের নীতিগুলোকে বদলে দিতে পারেন, নীতিগুলোকে বন্ধ করে দিতে পারেন, নতুন নীতি চালু করতে পারেন, ঠিক তেমনই প্রাথমিক স্তরে বহু আধুনিক বিজ্ঞানীই মনে করতেন প্রকৃতির নীতিগুলোও ঠিক একইভাবে ভগবান চাইলেই বদলে দিতে পারেন, বন্ধ করে দিতে পারেন অথবা নতুন নীতি চালু করতে পারেন। কিন্তু তাঁদের যুক্তি অনুযায়ী ভগবান হলেন এই বিশ্বের বিধানকর্তা এবং ডিজাইনার। তেমন কিছু একজন আশ্চর্য ক্ষমতাবান কর্মী নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানী প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে তাঁদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় একের পর এক গাণিতিক সমীকরণের ভাষায় প্রকাশ করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, এখনও বিজ্ঞানীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা হলোএকটি গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নীতিগুলোকে ব্যাখ্যা করা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়,বিজ্ঞান যদি সফলও হয় এই সমস্ত সমীকরণের মাধ্যমে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে, তাহলেও কি এটা প্রমাণিত হয় যে ভগবানের কোনো প্রভাব নেই এই প্রকৃতির উপরে? এ এক কঠিন তর্কের বিষয়। প্রকৃতির এইসব নীতিকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন পণ্ডিতেরা বিভিন্ন ভাবে বিচার করেন, বিভিন্ন ভাবে চিন্তা করেন। বিজ্ঞানের বাইরেও যাঁরা দার্শনিক আছেন তাঁরাও অন্যভাবে বিচার করেন। এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে,মৌলিক নীতি যা পদার্থবিজ্ঞান দিয়েছে সেটাই বেশি মৌলিক,নাকি যে জ্ঞান মানুষ অর্জন বা প্রাপ্তহয় জীববিজ্ঞান থেকে, সমাজবিজ্ঞান থেকে অথবা আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সেটাই মৌলিক? কোয়ান্টাম মেকানিকস (বলবিজ্ঞান) যেমন অত্যন্ত স্পষ্টতা এবং নির্ভুলভাবে অণু, পরমাণু এবং অতিপারমাণবিক পদার্থের বৈশিষ্ট্যকে বর্ণনা করতে সক্ষম, কিন্তু এখন অবধি, বিশ্বের ঘটমান অনেক ক্ষেত্রেই সেই প্রয়োগ সফল নয়। এটা যেমন সত্যি তবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে কাজে লাগিয়ে তার যে জবাব দিহি করা যাবে না সেই যুক্তিরও আবার কোনো অর্থ নেই। ফলত ভূ-তত্ত্বতবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, এবং মেটেরিয়াল-সায়েন্স এই সমস্ত বিষয়গুলো অনেক্ষেত্রেই কিছুটা কার্যকর বলে মনে হয়। সেখানে যে নীতিগুলো প্রয়োগ করা হয় তা কিন্তু সেই পদার্থবিদ্যার মৌলিক নীতিগুলোর উপর ভিত্তি করেই তৈরি। অনেকে আবার যুক্তির খাতিরে বলেন এই যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এই দুটি অত্যন্ত মৌলিক বিজ্ঞানের সফলতম থিয়োরি, এরাও নাকি একে অন্যের পরিপূরক নয়। এই যুক্তি দিয়েও কি এটা প্রমাণিত হয় এই মৌলিক নীতিগুলি দিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ নিয়মকে ব্যাখ্যা করা যায় না। না সঠিক নয়। কিছু দার্শনিক এই প্রস্তাবও দেন আধুনিক বিজ্ঞান কয়েকটি মৌলিক নীতি যা প্রতিসাম্যতার নিয়মগুলো মেনে চলে, বাস্তবে এই জটিল পৃথিবীতে যেখানে আমরা বেঁচে থাকি সেইসব নীতির প্রয়োগ অতি সামান্যই, আর প্রয়োগ থাকলেও তার যথার্থতা শুধুমাত্র ক্ষেত্র বিশেষে। এর থেকেও বড়োকথা,পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং অর্থনীতি প্রয়োগ করে হয়তোএ ই জটিল পৃথিবীর অল্পকিছু ঘটনারই জবাবদিহি করা সম্ভব। কিন্তু শুধুমাত্র একটি বিষয় দিয়েই সমস্ত ডোমেইনকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।
একটি বিষয় দিয়েই সমস্ত ডোমেইনকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব
ধরে নেওয়া যাক,একটি পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে আছে অনেক গুলো উপত্যকা।আর সেই উপত্যকা গুলো কেএক অন্যের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মাপের বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড় দিয়ে। সেই নির্দিষ্ট উপত্যকাগুলো মধ্যে চলে তাদের নিজের নিজের আইন-কানুন, নিজের কর্ম-পদ্ধতি। কিন্তু একটি উপত্যকার নিয়মনীতি দিয়ে অন্য উপত্যকার কার্যকলাপকে বর্ণনা করা শুধু অসম্ভবই নয়, সেই উপত্যকাগুলো মধ্যে কোনো যোগসূত্রও নেই। ইদানীং কালে অবশ্য এইসব যোগসূত্র যে একেবারে ঘটছে না সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই।
ভরসা কি শুধু ডিটারমিনিসটিক বা নিয়ন্ত্রনবাদ নীতির উপরই
কিছু দার্শনিক আবার এ-ওমনে করেন যে সমস্ত বিজ্ঞানীর ধর্মের প্রতি আস্থা বা ভরসানেই, যাঁরা সেই অর্থে তার্কিক এবং যুক্তিবাদী নাস্তিক, তাঁদের প্রাকৃতিক সর্বজনীন বিজ্ঞানের মৌল নীতিগুলোর উপরই ভরসা। তাঁদের সেই ভরসা ডিটারমিনিসটিক বা নিয়ন্ত্রনবাদ নীতির উপরই ভিত্তি করে আছে। তার মানে হলো আমাদের যদি বর্তমান বিশ্ব সম্বন্ধে একবারে সঠিক এবং নিশ্চিত ধারণাথাকে তবে সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে শুধুমাত্র আগামী দিনের বিশ্বকেই গণনা করা যাবে শুধু এমন নয়,অতীতকেও নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।আর এখানেই যাঁরা ধার্মিক তাঁদের কিছুটা অন্যমত। যা দেখা সম্ভব নয়, যে ঘটনা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়,তা কী করে নির্ধারিত হবে?মানে অতীতকে তো আর চোখের সামনে দেখা যায় না এবং তাকে স্পর্শও করা যায় না। অতীত যদি কয়েক কোটি বছর পূর্বের হয় তাহলে সেই ধারণাকে উপলব্ধি করা সে এক অন্য অধ্যায়। ঠিক অন্যদিকে আবার ভবিষ্যতকেও দেখা যায় না। শুধু অনুমান করা যায়। তাই নিয়ন্ত্রণবাদনীতির উপর ভরসা করা মানে,কিছু গাণিতিক সমীকরণের উপর ভিত্তি করেই এগোতে হবে।যদিও পরীক্ষাগারে কিছু বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে অতীতের কোনো দশাকে তৈরি করা যেতে পারে, তবে সেই পরীক্ষার যথার্থতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যাবে।
যুক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে ভগবানের অস্তিত্বের কথা
এবার একটু আলোচনা করা যাক কিছু নাস্তিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভগবানের অস্তিত্বের কথা। আমরা আগেই আলোচনা করেছি সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ প্রশ্ন করে এসেছে। এবং সেই প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান একে একে দিয়ে এসেছে। এইগুলি হলো সহজাত বা স্বাভাবিক কৈফিয়ত। কারণ এবং ফল, এই প্রাকৃতিক যুক্তিকে যদি মেনে নিই, তাহলে মোটামুটি এটা বলা যায়,বিজ্ঞান এবং যুক্তি ধারাবাহিক ভাবে মানুষের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে এসেছে। কিন্তু কটি প্রশ্নের উত্তর অতিপ্রাকৃত, ভগবান, আত্মা, অপদেবতা, ভাব–এই সব সময়ের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে দিতে পেরেছে! আর দিলেও সেখানে কতকগুলো প্রামাণিক তথ্যের উপস্থিতি। প্রামাণিকতথ্য থাকলেও সেই তথ্য কতটা অনুকৃতি যোগ্য,কতোটা ধৈর্যের সঙ্গে পরীক্ষিত? আচ্ছা তবু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় বর্তমানে অন্তত কিছু ঘটমান বিষয়, মানুষের উপলব্ধি অথবা বিশ্বের সৃষ্টি একমাত্র অতিপ্রাকৃত বা ভগবানকে ধরে নিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের যুক্তি উত্তর দিতে প্রস্তুত। ভগবানের অস্তিত্ব সেখানেও তোপ্রমাণিত নয়।কিন্তু যে প্যাটার্নে এখন সমস্ত যুক্তির বিকাশ তাতে এটাই ধরে নেওয়া যায় ভগবানের অস্তিত্ব যৌক্তিকতা শূন্যের কাছাকাছি। পরম শূন্য তাপমাত্রায় যেমন চেষ্টা করলেও পৌঁছানো সম্ভব নয়, ঠিক সেই কারণেই ‘শূন্যের কাছাকাছি’ শব্দদুটি এখানে প্রয়োগ করা হলো, একেবারে শূন্য বলা হলো না।
আচ্ছা যদি ধরেও নেওয়া যায় ভগবানের অস্তিত্ব বাস্তব, সেক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মেরমধ্যে বা মানুষের অনুধাবনের ক্ষেত্রে কেন এত অসংগতি? কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে দেখা যায়। আবার তাঁকে কখনো কল্পনা করা যায়। আমরা যখন একটা গাছকে দেখি,আমরা মোটামুটি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এটা একটা গাছ। আমাদের মধ্যে বাদানুবাদ হতে পারে এই নিয়ে সেটা কোন প্রজাতির গাছ, কোথা থেকে এর উৎপত্তি, এটা কি প্রতিসম, এটা কি আকর্ষণীয়, এটা কি উপকারী বা অন্যরকম কিছু, এই গাছটিকে কি কেটে দেওয়া উচিত।এইরকম হাজারো বিষয়ের উপর আমরা বাদানুবাদ করতে পারি। কিন্তু সেটা যে গাছ,সেই বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত থাকবে না। কিন্তু ভগবান যদি থেকেই থাকেন তিনি এত বিশাল, এত শক্তিশালী, এত ক্ষমতাবান তাঁকে তো দূর থেকে একই রকম দেখতে লাগার কথা। সহজ উত্তর কি এটা নয় ভগবানের কোনো অস্তিত্বই নেই?
ভগবানের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের মাঝে মধ্যে যুক্তিগুলো ঠিক এইরকম। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরা বলেন ভাগবান আছেন,কারণ ধর্মগ্রন্থগুলো সেই কথাই বলে, তা সে বাইবেল হোক, তা সে কোরান হোক অথবা গীতা হোক। মানুষ বলেন ভগবান আছেন আমার অন্তরে, আমার মনে, কারণ আমি সেই ভগবানকে অনুভব করতে পারি। ভগবান এমন কিছু যাঁর অস্তিত্ব কার্য-কারণ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। ভগবান মানে হলো ভালোবাসা, ভগবান মানে হলো শ্রদ্ধা, ভগবান মানে হলো ভক্তি। কিন্তু এইগুলো কি একটিও বলিষ্ঠ যুক্তি,ভগবানের অস্তিত্বের সপক্ষে?
স্টেডি স্টেট থিয়োরি অফ ইউনিভার্স যা এক সময় বিশ্বাস করা হতো, ছাত্রদের শেখানো হতো, তা কি আজ মানুষকে শেখানো হয়?না,হয় না
ধর্ম চালায় একটি সংসারকে। অধিকাংশ মানুষ,সে যে ধর্মেই বিশ্বাসী হোক না কেন,সে সেই ধর্মের প্রতি বিশ্বাসী হয় যেভাবে তার ছোটো বেলায় তাকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করানো হয়। সেই বেড়ে ওঠা মানুষটির হাতে অন্য ধর্মকে বা ভগবানকে যাচাই করে দেখবার মতন কোনো সুযোগই থাকে না। কোন ধর্মটি বা কোন ভাগবান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো কে যথাযথ বর্ণনা করতে পারে সেই সুযোগটাই সে পায় না। মানে একটা ধর্মকে এই পৃথিবীতে আসা হয়,একটি নতুন প্রজন্মের উপর শুধু চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর পরেহয়ে যায় সেটা তার দায়ভার। মানে পরিবারের রীতি নীতি বহন করে নিয়ে যাওয়াটাই ধর্মের একটি নাম। অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে নেয় সেই ধর্মকেই,যে ধর্ম তাকে ছোটোবেলায় শেখানো হয়েছিল। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা একেবারেই সম্ভব নয়। সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো একটি রীতি যা যথাযথ,তাই কিন্তু ছোটোবেলায় বিদ্যালয়ে শেখানো হয়। স্টেডি স্টেট থিয়োরি অফ ইউনিভার্স যা এক সময় বিশ্বাস করা হতো, ছাত্রদের শেখানো হতো, তা কি আজ মানুষকে শেখানো হয়?না,হয় না। এখন এটা প্রমাণিত বিগ-ব্যাং থিয়োরিই আসলে কার্যকর। মানুষ একসময়ে জিওসেন্ট্রিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। আজ তা বাতিল,কারণ সেই থিয়োরির কোনো যুক্তি নেই। ফোর বডিলি হিউমরস থিয়োরি অফ ইলনেস–এইসবকি আজকাল শুনেছে স্কুলে নিজের পড়াশুনা করার সময়ে? এইসব আজকাল পাঠক্রমেই নেই। আর থাকবেই-বা কেন! এইসবে তো কোনো যুক্তি নেই।
এই অবধি আলোচনাতে এটা অন্তত পাঠকদের পরিষ্কার হওয়া উচিত যুক্তির উপরে ভিত্তি করে আমরা যদি বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করি যে প্রশ্নের উত্তরের চেষ্টায় এই প্রবন্ধটি লেখা,সেই প্রশ্নটিই আসলে অর্থহীন। বাকিটা থাকল যুক্তিবাদী পাঠকদের বিবেচনার জন্যে।
Comments