অবতারণা:
১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৫, মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমবার আমরা "শুনতে" পেয়েছিলাম "স্থানকালের" (spacetime) কম্পন। লেখার প্রথম বাক্যই যদি দুর্বোধ্য হয়, তাহলে সেই লেখা পড়ে বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে থাকি আমরা সকলেই। কিন্তু আমার এই লেখার উদ্দেশ্য পাঠকদের বোঝানো যে ওপরের ওই প্রথম বাক্যটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মানব জাতির অগ্রগতির ইতিহাসের এক দুর্দান্ত উদাহরণ। আজ আমরা সেই ইতিহাসের দিকে নজর রাখবো আর সঙ্গে থাকবে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে ওই প্রথম বাক্যটিকে বোঝা। হেঁয়ালি না করে এই বেলা বলে রাখা যাক যে আমি এই লেখা লিখতে বসেছি পাঠককে মহাকর্ষ তরঙ্গ সম্পর্কে কিছু জানানোর জন্য। ওই ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে আমেরিকার ওয়াশিংটন আর লুইজিয়ানা প্রদেশে অবস্থিত LIGO (laser interferometric gravitational wave observatory) যন্ত্রে স্থানকালের কম্পন ধরা পড়েছিল, যে কম্পনের উৎস ছিল প্রায় ১৩০ কোটি বছর আগে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে প্রবল ধাক্কা। এই মহাজাগতিক ধাক্কাধাক্কি স্থান ও কালে সৃষ্টি করেছিল কম্পন আর সেই কম্পন পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১৩০ কোটি বছর আর তা ধরা পড়েছিল LIGO নামক ওই যন্ত্রে। আজকে আমাদের উদ্দেশ্য এই লেখার মাধ্যমে সেই রোমহর্ষক আবিষ্কারের কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরা, যে কাহিনীর পরতে পরতে রয়েছে নতুন আবিষ্কারের আনন্দ, ব্যর্থতার দুঃখ, কঠিন সমস্যার বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান আর সর্বোপরি, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই গল্পটা বুঝতে গেলে আসলে আমাদের জানতে হবে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব। কি সেই তত্ত্ব, কেন তার প্রয়োজনীয়তা, নিউটনের মহাকর্ষের তত্ত্বের গলদ কোথায় এবং কেন আইনস্টাইন মনে করেছিলেন যে নিউটনের তত্ত্ব বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় - এই বিষয়গুলো একটু ভালো করে বোঝার প্রয়োজন মহাকর্ষ তরঙ্গ সম্পর্কে গল্পের অবতারণা করার আগে।
মহাকর্ষকে আমরা যে ভাবে জেনে এসেছি:
আমাদের আলোচনা আমরা শুরু করি একটু পিছিয়ে গিয়ে, যাতে মহাকর্ষকে একটু ভালো করে বোঝা যায়। লেখার এই অংশটি কিছুটা ইতিহাস এবং কিছুটা বিজ্ঞান - এই অনুসারে সাজানো যাতে অনুসন্ধিৎসু পাঠক পরবর্তী অনুচ্ছেদের লেখাগুলো বুঝে উঠতে পারেন। এই পিছিয়ে গিয়ে দেখার যাত্রাপথে প্রথম যে মানুষটিকে আমরা দেখতে পাই, তিনি হলেন গ্রীস দেশের সামোস দ্বীপের এরিস্টার্কাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০ - খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০), একজন গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ। সূর্য যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না, বরং পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকে ঘুরছে - যা আজকে পরিচিত হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব নামে - এই ধারণার প্রবর্তক ছিলেন তিনি। বলে নেওয়া ভালো যে এই ধারণা তখনকার যুগে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং প্রায় ১৮০০ বছর পর নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩ - ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রহণ করেন এরিস্টার্কাসের প্রস্তাবনা ও সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্ব দেন। আর তার ফলে প্রবল সমালোচনা এবং চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তারও পরে জোহানেস কেপলার (১৫৭১ - ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ) সূর্যের চারদিকে গ্রহদের কক্ষপথ আরো নির্ভুল ভাবে গণনা করেন। সূর্যের চারপাশে গ্রহদের প্রদক্ষিণ করার নির্ভুল কারণটি স্যার আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২ - ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দ) ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর মহাকর্ষ সূত্রের প্রয়োগ করে। আমরা এই মহাকর্ষ নামক বিষয়েই আজকের আলোচনা করবো এবং সেই আলোচনায় নিউটনের ঠিক আগে যাঁর নাম আসবে, তিনি হলেন গ্যালিলিও (১৫৬৪ - ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দ)। গ্যালিলিওর সময়ে কামানের গোলার আবর্তপথ (trajectory) নিয়ে গবেষণার খুব প্রচলন ছিল, কারণ তখনকার দিনে যুদ্ধ জয়ের অন্যতম হাতিয়ার ছিল কামান। গ্যালিলিও এই বিষয়ে নিজের গবেষণাগারে কাজ করতে গিয়ে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাঁর পরীক্ষাগুলির ফলাফল বেশ আশ্চর্যজনক ছিল তখনকার দিনের মানুষের কাছে। ইতালির পিসা শহরের হেলানো মিনার থেকে করা তাঁর সেই বিখ্যাত পরীক্ষা, যেখানে একটি ভারী ও আরেকটি অপেক্ষাকৃত হালকা লোহার বল ওপর থেকে ফেলে তিনি দেখেছিলেন যে কোনো বস্তুকে যদি বাধাহীন ভাবে ওপর থেকে নিচে পড়তে দেওয়া হয় তাহলে বস্তুর পতনের হার সেই বস্তুর ওজনের ওপর নির্ভর করে না। এছাড়াও তিনি পতনশীল বস্তুর পতনের হার বা ত্বরণ (acceleration) মেপে দেখলেন যে তা আসলে ধ্রুবক। কিন্তু এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা সাধারণ বুদ্ধিতে বেশ কঠিন, কারণ একটা ভারী বস্তুকে নিচ থেকে ওপরে তুলতে হালকা বস্তু ওপরে তোলার তুলনায় কষ্ট হয় বেশি, তার মানে কি এই নয় যে ভারী বস্তু ওপর থেকে ছেড়ে দিলে নিচেও নেমে আসবে তাড়াতাড়ি? গ্যালিলিও বললেন যে আমরা যদি বাতাসের জন্য তৈরী হওয়া বাধা উপেক্ষা করি, তাহলে বস্তুর ওজন তার ওপর থেকে নিচে পড়ার হারের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। গ্যালিলিওর এই তত্ত্ব পরবর্তীকালে আইনস্টাইনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আরেকটি গূঢ় তত্ত্বের অবতারণা করতে - আজ যা আমরা principle of equivalence বা সাম্যের নীতি বলে জানি। সে বিষয়ে আমরা যথাসময়ে আলোচনায় আসবো। সত্যি কথা বলতে কি, গ্যালিলিও আরো বেশ কিছু কাজ করেছিলেন, যা নিউটনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর বিখ্যাত গতিসূত্রগুলি প্রকাশ করতে। গ্যালিলিওই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি প্রথমবারের জন্য আপেক্ষিকতার তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেছিলেন। আইনস্টাইন নিউটনের গতিসূত্র এবং মহাকর্ষ সূত্রের সীমাবদ্ধতা বুঝে সেগুলিকে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন গ্যালিলিওরই আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ওপর কিছুটা ভিত্তি করে। আগেই বলেছিলাম যে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের তত্ত্ব খুব একটা জনপ্রিয় হতে পারে নি, বরং তা সমাজের একটা অংশের মানুষের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। আর এই বিরোধিতার মূল কারণ ছিল এটাই যে, পৃথিবী যদি স্থির না থেকে সূর্যের চারদিকে দৌড়েই বেড়াচ্ছে তাহলে আমরা, পৃথিবীর ওপর বসবাস করা মানুষ সেই গতির কোনো প্রমাণ পাই না কেন? পৃথিবী পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে যদি একটা বল ওপর দিকে ছোঁড়া হয়, তাহলে সেটা তো পিছনের দিকে গিয়ে পড়ে না, সেটা তো যে ছুঁড়েছে তারই হাতে এসে পড়ে। পৃথিবী যদি এগিয়েই যাবে, তাহলে বলটা তো পেছনের দিকে গিয়ে পড়ার কথা! কিন্তু ওইরকম তো হয় না। গ্যালিলিও তখন একটি উপমার সাহায্য নিয়ে বললেন যে ধরা যাক একজন মানুষ একটা জাহাজের বদ্ধ কেবিনে করে একটা শান্ত সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে অভিন্ন গতিবেগে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি সব দরজা জানলা বন্ধ থাকে আর সমুদ্র যদি শান্ত থাকে, তাহলে সে কি বুঝতে পারবে যে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে? কেবিনে থাকা সমস্ত বস্তুই জাহাজের সমান গতিবেগ নিয়ে এগোচ্ছে আর তার ফলে কেবিনে বসে যদি একটা বল ওপরের দিকে ছোঁড়া হয়, তাহলে সেটা হাতে এসেই পড়বে। গ্যালিলিও বললেন পৃথিবীর গতিও এইরকম। যা কিছু ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করছে, গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষজন, নদীনালা - এ সবই পৃথিবীর সঙ্গে ছুটে চলেছে আর তাই পৃথিবীর ওপর দাঁড়িয়ে গতিবেগ বোঝা অসম্ভব, যদি না আমরা বহু দূরের কোনো বস্তু যেমন কোনো নক্ষত্রের দিকে তাকাই। আইনস্টাইন এই ধারণাটিকেই আরেকটু ঘষে মেজে বললেন পদার্থবিদ্যার যে কোনো সূত্র বা তত্ত্ব একজন স্থির ব্যক্তির কাছে যা, অভিন্ন বেগে ছুটে চলা অন্য একজন ব্যক্তির কাছেও তাই। এটা আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের (special theory of relativity) একটি স্বীকার্য (postulate)। এই বিষয়ে আমরা আবার পরে ফিরে আসবো। এখন আসা যাক মহাকর্ষের কথায়। গ্যালিলিও মহাকর্ষ নিয়ে কাজ করলেও, তা ছিল খুবই গুণগত গবেষণা। মহাকর্ষকে কোনো সূত্রের মাধ্যমে বেঁধে ফেলতে পারেন নি তিনি। এই কাজটা করেছিলেন নিউটন। তাঁর মাথায় আপেল পরার পর তিনি মহাকর্ষের সম্মন্ধে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছিলেন কি না - এই বিষয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটা মানুষজন সঠিক তথ্য দিতে পারবেন, কিন্তু এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে নিউটন মহাকর্ষ সূত্রের প্রস্তাবনা করে বলেছিলেন যে একটা ভরযুক্ত বস্তু সব সময় অন্য একটা ভরযুক্ত বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এবং যে বল এই দুটি বস্তুর মধ্যে কাজ করে, তার একটি সূত্রও (ফর্মুলাও) বলে দিলেন তিনি: মহাকর্ষ বল বস্তুদুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও বস্তুদুটির মধ্যেকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বলের কারণেই পৃথিবীসহ অন্যান্য সব গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে, বাঁধা না পেলে উঁচু জায়গা থেকে কোনো বস্তু নিচু জায়গায় চলে যায়, রকেটে চেপে মহাকাশে যেতে গেলে একটা বিশেষ গতিবেগ নিয়ে পৃথিবীর আকর্ষণ বলকে কাটাতে হয়। কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সূত্রের সফল প্রয়োগ করা গেলেও বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, আর এখানেই প্রয়োজন হয় সাধারণ আপেক্ষিকতার (general relativity)। এখন দেখে নেওয়া যাক যে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কেন এবং কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই সূত্রের প্রথম সমস্যা লুকিয়ে আছে এর তাৎক্ষণিক প্রকৃতির (instantaneous nature) ওপর। দুটি ভরযুক্ত বস্তু যত দূরেই থাকুক না কেন, তাদের মধ্যেকার বল পরিবর্তিত হতে পারে তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে যদি একটা বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন করা হয়। আরেকটু সহজ ভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে আজ যদি হঠাৎ করে সূর্য ধ্বংস হয়ে যায়, আমাদের পৃথিবী কী তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারবে সেই পরিবর্ত ও নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাবে জ্যামুক্ত তীরের মতো। কিন্তু পৃথিবী কি করে সূর্যের ধ্বংস হয়ে যাওয়া তাৎক্ষণিক ভিত্তিতে টের পাবে? সূর্য থেকে কোনো সিগন্যাল পৃথিবীতে এসে পৌঁছলে তবেই জানা সম্ভব যে সূর্য আর নিজের অবস্থানে নেই। এই সিগন্যাল পৃথিবীতে পৌঁছতে একটা নির্দিষ্ট সময় লাগে, তা কখনোই তৎক্ষনাৎ পৌঁছতে পারে না। যদি সূর্যের আলো একটা সিগন্যাল হয়, তাহলে আমরা জানি যে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে তার সময় লাগে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড। অর্থাৎ এই মুহূর্তে যদি সূর্য ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেই খবর পৃথিবীতে পৌঁছতে কমপক্ষে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগা উচিত। অর্থাৎ সূর্যের ধ্বংস হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে খবর পৌঁছনো কোনো মতেই সম্ভব না।
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র যে ভাবে কাজ করে সেটাকে বলে "instantaneous action at a distance"। আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মাধ্যমে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের এই "instantaneous action at a distance" সমস্যাটির সমাধান করেন। এছাড়াও নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব কিছু কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা করতে অপারগ। যেমন জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার পরীক্ষায় দেখা যায় যে মহাকাশে খুব ভারী কোনো বস্তুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। আলোর ভর নেই, আর তার ফলে নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী মহাকর্ষ বলের প্রভাব পড়া উচিত নয় আলোর গতিপথের ওপর। তা হলে ভারী বস্তুর প্রভাবে আলোর গতিপথের পরিবর্তন নিউটনীয় ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এছাড়াও, বুধ গ্রহের অনুসূর গতি (perihelion precession of mercury) নিউটনীয় মহাকর্ষের ধারণা থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন যে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করার সময় বুধগ্রহের কক্ষপথে সূর্যের সবথেকে কাছের বিন্দুটি (অনুসূর বিন্দু) সময়ের সাথে ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বুধ গ্রহের এই অনুসূর গতিকেও ব্যাখ্যা করতে পারে না। সাধারণ ভাবে বলা যায় যে মহাকর্ষ যে অঞ্চলে খুব শক্তিশালী, সেই স্থানে নিউটনীয় মহাকর্ষ তত্ত্ব খাটে না। তাহলে এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক যে মহাকর্ষ বলকে কখন খুব শক্তিশালী বলা হবে? কোনো স্থানে শক্তিশালী মহাকর্ষ বলতে আমরা এটাই বুঝবো যেখানে কোনো কিছুই (এমনকি আলোও) সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। দেখা যায় যে কোনো স্থানে যদি মহাকর্ষ খুব শক্তিশালী হয়, তাহলে সেখানে যেকোনো বস্তুর গতিবেগ প্রায় আলোর বেগের সমতুল হয়। এবং, যখন আমরা আলোর কাছাকাছি বেগে ছুটতে থাকা কোনো বস্তুর সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইবো, তখন কিন্তু সাধারণ নিউটনীয় গতিসূত্র কাজ করবে না, কাজে লাগবে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। অর্থাৎ, এটা বোঝা গেলো যে যদি আমরা কোনো স্থানে শক্তিশালী মহাকর্ষের প্রভাব আলোচনা করতে চাই, তাহলে আপেক্ষিকতার হাত থেকে রেহাই নেই।
এবার আসা যাক আপেক্ষিকতার তত্ত্বে। এখনো অবধি আমরা দুটি নাম শুনলাম, একটি বিশেষ (special) ও অন্যটি সাধারণ (general) আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে নাম শুনে বোঝা সম্ভব নয় কোন তত্ত্ব কি বিষয়ে আলোচনা করেছে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বা special theory of relativity আমাদের বলে কি ভাবে কোনো বস্তুর ভর, দৈর্ঘ্য, সময় এবং শক্তি কোনো দর্শকের ওই বস্তুর সাপেক্ষে গতির ওপর নির্ভর করে। সেই অর্থে দেখতে গেলে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ কিন্তু পদার্থবিদ্যার কোনো বিশেষ ভৌত অবস্থার ব্যাখ্যা করে না, বরং এটি কিছু মৌল নীতি (postulates) বলে দেয় যা পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন শাখা মেনে চলতে বাধ্য, যাতে এই সব শাখাগুলিতে যখন খুব দ্রুতগতির বস্তু সংক্রান্ত কোনো গণনার দরকার হবে তখন নির্ভুল ফল পাওয়া সম্ভব হয়। সমস্ত ভৌতিক তত্ত্ব (physical theories), গতিবিদ্যা, বলবিদ্যা থেকে তড়িচ্চুম্বকীয় তত্ত্ব বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব - এ সব কিছুরই একটা বিশেষ আপেক্ষিক প্রতিরূপ রয়েছে। মহাকর্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (general theory of relativity) এই কাজটি করে।
মহাকর্ষ ও জ্যামিতি:
এখনো অবধি যত পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সবেতেই সসম্মানে উত্তীর্ন হয়েছে। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যে শুধুমাত্র মহাকর্ষের তত্ত্বের আপেক্ষিক প্রতিরূপ কিংবা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের পরিবর্তে নতুন কোনো মাধ্যাকর্ষণের সূত্র দেওয়া একটি তত্ত্ব তাই নয় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মহাকর্ষের ধারণাটা অনেকাংশে পাল্টে দেয় ও আমাদের নতুন আঙ্গিকে ভাবতে শেখায়। এই নতুন আঙ্গিকটি হলো স্থান ও কালের মেলবন্ধন এবং এদের একত্রে স্থানকাল হিসেবে দেখা। বস্তুর স্থানের ত্রিমাত্রিক নিউটনীয় ধারণা যেখানে সময় কেবল একটি প্যারামিটার বিশেষ, বদলে যায় বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের দৃষ্টিতে। এ তত্ত্বে স্থান ও কালের কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই, স্থানকাল মিলে একটি চতুর্মাত্রিক ধারণা। নিউটনীয় মহাকর্ষের তত্ত্বে মহাকর্ষ একটা বল, কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্বে মহাকর্ষ ব্যাখ্যাত হয় জ্যামিতির নিয়মে। আইনস্টাইনই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে কোনো বস্তুর উপস্থিতি তার চারপাশের স্থানকালকে বেঁকে-চুড়ে দিতে পারে। সেই বেঁকে যাওয়া স্থানকালই ওই বস্তুর চারপাশে অন্যান্য বস্তুর গতিপথ নির্ণয় করে দেবে। ধরা যাক আমার হাতে একটি কাগজ রয়েছে আর তার ওপর আমি কয়েকটি সরলরেখা টেনে রেখেছি। এবার আমি যদি ওই কাগজটিকে দুমড়ে মুচড়ে দিই, তাহলে ওই সরলরেখাগুলিও আর সরলরেখা থাকবে না - বক্ররেখা হয়ে যাবে। এবার ধরা যাক একটা পোকা প্রথমে আমার হাতে থাকা কাগজে আঁকা সরল রেখার ওপর দিয়ে হাঁটছিল। কাগজটিকে দুমড়ে দেওয়ার ফলে ওই পোকাটি এখন আর সরলরেখায় হাঁটবে না, সে একটি বক্ররেখা ধরে যাবে। অনেকে বলতে পারেন যে এটা হলো তার কারণ আমি কাগজের ওপর বল প্রয়োগ করে মুচড়ে দিয়েছিলাম বলে, কিন্তু পোকাটির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে শুধু বল প্রয়োগের জন্য এটা হয়নি, বরং কাগজের জ্যামিতিটা পরিবর্তিত হবার জন্যই পোকাটি বক্ররেখা ধরে হাঁটছে।
(চলবে...)
Written by Prof. Sayan Chakrabarti, Assistant Professor, Department of Physics, IIT Guwahati.
Komentāri