top of page
Search
Writer's picturescienceandargument

পৃথিবীর চুম্বকত্ব Earth Magnetism

Updated: Jul 11, 2022


পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী আছে বা পৃথিবী কী কী বস্তু বা পদার্থ দিয়ে তৈরি? —প্রশ্নগুলি কিন্তু আজকের নয়। কয়েকশো বছর আগেও এর সঠিক উত্তর নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত ছিলেন। এমনকী বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বর্তমানে যদিও এই বিষয়ের ধারণা অনেকটাই পূর্ণতাপ্রাপ্ত। নামজাদা বেশকিছু বিজ্ঞানী এবং গবেষকের মধ্যে প্রভূত বাদানুবাদ লেগেই থাকত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জুল ভার্ন-এর বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের বই এ জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ, নেহাতই কল্পবিজ্ঞানের একটি বই। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যে অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভব নয়, আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ফলে অর্জিত তথ্য এবং প্রযুক্তি অন্তত তাই নির্দেশ করে। তবে ভবিষ্যতে তা মানুষ করে উঠতে পারবে না, সেটা বলাও হয়তো খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ২০২২ সালের চিত্র অনুযায়ী মাইনিং-এর জন্যে অথবা পৃথিবীর উপরিতলে অবস্থিত গভীর গুহার মধ্যে যে দূরত্বে মানুষ পৌঁছোতে পেরেছে, তা কয়েক কিলোমিটারের বেশি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিতে কর্মরত দক্ষ শ্রমিকেরা খুব কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩থেকে ৪ কিলোমিটার অবধি নিয়মিত পৌঁছোতে পারেন। বর্তমানে জানা সবচেয়ে গভীর গুহা অবস্থিত জর্জিয়া দেশের ককেশাস পর্বতে, তারও গভীরতা ২.২ কিলোমিটারের বেশি নয়। সেখানেও মানুষ তার বহুদিনের পরিশ্রমের ফলে অর্জিত তথ্যপ্রযুক্তিকে এবং অ্যাভেঞ্চারের নেশায় মত্ত হয়ে যাওয়ার প্রণোদনাকে কাজে লাগিয়ে পৌঁছোতে পেরেছে। তা নিশ্চিত প্রশংসারই দাবি রাখে। শুধু মহাকাশেই মানুষ হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয়নি, আমাদের বাসস্থান এই নীল পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে পৌঁছোনোর সদিচ্ছাও হয়তো বহু মানুষের আছে। তবে প্রযুক্তির নিরিখে সেখানে আছে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা। পৃথিবীর গভীরে পৌঁছোনোর সরাসরি কোনো রাস্তার নাগাল মানুষ এখনও পায়নি। এর গভীরে প্রবেশ করা মানে সেই স্থানের তাপমাত্রা এবং চাপ প্রবল হয়ে ওঠে। প্রতি ১ কিলোমিটারের ব্যবধানে প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা তারতম্য ঘটে। তাতে মানুষের মতন একটি দুর্বল প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ বজায় থাকে না। মানুষের তৈরি করা বিশেষ যন্ত্র পৃথিবীর উপরিতলের কঠিন আস্তরণকে ভেদ করে প্রায় ১২.২ কিলোমিটার অবধি পৌঁছোতে পেরেছে দ্য কোলা সুপারডিপ বোরহোল নামক যন্ত্রটির সাহায্যে, এবং এই প্রযুক্তি এনেছে রাশিয়া। তুলনার জন্যে এখানে বলা রাখা দরকার পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হল ৬৩৭৮ থেকে ৬৩৫৬ কিলোমিটারের মতন। এই দূরত্ব নির্ভর করছে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ কোথায় মাপা হচ্ছে তার উপরে, অর্থাৎ নিরক্ষরেখা থেকে পৃথিবীর মাঝবরাবর একটি কল্পিত রেখায়, নাকি পৃথিবীর দুই মেরু থেকে মাপা হচ্ছে। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সত্যেও সহজ গণনা করলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর ব্যাসার্ধের মেরেকেটে মাত্র ০.২ শতাংশ সরাসরি মানুষ নাগালে এসেছে। এর চেয়ে বেশি গভীরে আমাদের তৈরি কোনো যন্ত্রই এখনও অবধি পৌঁছোতে পারেনি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই নীল পৃথিবী কী কী পদার্থ দিয়ে তৈরি অথবা পদার্থগুলি সেখানে কী দশায় আছে, এই বিষয়ের যথাযথ এবং পরিপূর্ণ তথ্য আমরা পাব কী করে। তা অনুমান করা হলেও তার পরিমাপই-বা কী করে পাওয়া সম্ভব হবে। বিষয়টি যে একেবারেই সহজ নয় তা অন্তত আমরা আন্দাজ করতে পারছি। পৃথিবী কী দিয়ে তৈরি এই বিষয়ে যে তথ্য আজ অবধি পাওয়া গেছে, তা অনেকটাই বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত বলা যায়। ইংরেজি পরিভাষায় আমরা বলতে পারি পুরোটাই ‘রিমোট সেন্সিং’-এর মাধ্যমে পাওয়া।

আমরা যখন একটি শক্ত কাঠবাদামকে দেখি, সেটা দেখে বাইরে থেকে তো আমরা বুঝতে পারি না তার ভিতরে কী আছে। কাঠবাদামটিকে আমাদের হয় ভাঙতে হয়, অথবা কেটে ফেলতে হয়। তবে আমরা জানতে পারি তার ভিতরে কী আছে। অথবা অন্য উপায়ও আজকাল আমাদের কাছে আছে, তা হল বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে বা বিভিন্ন তরঙ্গের আলো পাঠিয়ে তার ভিতরটিকে দেখে ফেলা। এই যেমন আমরা এক্স-রে ব্যবহার করি। তা তো সেই একধরনের আলোই। মানে ফোটন, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলো থেকে আলাদা। কম শক্তিশালী এক্স-রে কাজে লাগিয়ে আমরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূলত হাড়ের খুঁটিনাটি জেনে ফেলি। পাতলা কোনো পদার্থ হলে আমরা বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তার ভিতরে কী আছে জানি। সাধারণ মাইক্রোস্কোপ আলোর সাহায্যে দেখে ফেলে পদার্থের কোষের খুঁটিনাটি, কেলাসের বাইরের গঠন। আবার ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপকে, সেখানে ইলেকট্রনের স্রোতকে কাজে লাগিয়ে এক বিশেষ ধরনের ছবি তুলে পদার্থের আরও খুঁটিনাটি জানা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর মতন একটি বিশাল বস্তুর ক্ষেত্রে তার ভিতরে কী কী আছে তা জানবার জন্য অবশ্যই অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সেই পথ অবলম্বন করেই, বাকিটা সিমুলেশন এবং অন্যান্য যুক্তির সাহায্যে পৃথিবী কী কী পদার্থ দিয়ে তৈরি তার একটি মডেল তৈরি করা সম্ভব। শব্দতরঙ্গকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যদি পাঠানো সম্ভব হয় তবে সেই শব্দতরঙ্গ কীভাবে এক প্রান্ত থেকে অন্যে প্রান্তে যাবে, তা নিশ্চয়ই নির্ভর করবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে কী কী পদার্থ আছে তার উপর। এরপরে ধরা যাক ভূমিকম্পের জন্যে উৎপন্ন সেইসমিক তরঙ্গের কথা। প্রবল মানের সেইসমিক তরঙ্গ পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে ভূমিকম্পের জন্যে তৈরি হলে, সেই তরঙ্গ পৃথিবীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবে, এবং তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পরিমাপ করলে, দুই পরিমাপের ভিন্নতা থেকে, প্রাথমিক ধারণা তৈরি করা যাবে পৃথিবীর ভিতরে কীধরনের পদার্থ থাকতে পারে। এ ছাড়াও পৃথিবীর মহাকর্ষ বল, পৃথিবীর ওজন এ সবই একভাবে বা অন্যভাবে সাহায্য করে। এরই সঙ্গে পৃথিবীর উপরিভাগে উপস্থিত চুম্বকত্ব, এবং এ ছাড়াও মহাবিশ্বে লোহা তুলনামূলক বেশি ঘনত্বের পদার্থ, এইসব ধারণা একত্রিত করে, এবং বাকিটা যুক্তি এবং সিমুলেশনের মাধ্যমে বর্তমানে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারণা বিজ্ঞানীরা করেছেন।

পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে মূলত লোহা, উত্তপ্ত লোহা। এই তথ্য আজ আমাদের কাছে আর অজানা নয়। সেই লোহার তাপমাত্রা আবার খুবই বেশি। প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মূলত দুটি কারণে এই তাপমাত্রা খুব বেশি। প্রথমত, পৃথিবী যখন তৈরি হয় তা উত্তপ্ত গ্যাসীয় দশা থেকে তৈরি হয়, সেই তাপমাত্রার কোটি কোটি বছর ধরে বিকিরণ ঘটলেও, এবং তাপমাত্রা অনেকটা কমলেও, এখনও পুরোপুরি শীতল হয়নি। পুরো শীতল অবস্থায় আসতে আরও কোটি কোটি বছর লেগে যাবে। (এখানে বলে দেওয়া ভালো মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রা কিন্তু খুবই কম মাত্র -২৭০.৪ °C (-৪৫৪.৮ °F)। এখানে মাইনাস চিহ্নটি কিন্তু ভুল করে দেওয়া হয়নি। বাস্তবেই মহাবিশ্ব এত শীতল। দ্বিতীয়ত, বেশকিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ যা ক্রমাগত ঘটে চলেছে পৃথিবীর মধ্যে, তাও এই তাপমাত্রার জন্যে দায়ী। এ ছাড়া অবশ্য আরও দুটি কারণ আছে। পৃথিবীর কেন্দ্রে মূলত ভারী পদার্থগুলি চলে যাবার জন্যে ঘর্ষণজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। অন্য কারণটি হল লীনতাপ। এত উত্তপ্ত থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর কেন্দ্রের লোহা আবার তরল অবস্থায় নেই, আছে কঠিন দশায়। পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এ আমরা আগেই বলেছি, এবং যে চাপে সেখানে লোহা থাকে তার মান কম করে ৩৬০ গিগা-পাস্কালের (পৃথিবীর উপরিতলের প্রাপ্ত বায়ুমণ্ডলীয় চাপের প্রায় ৩,000,000 গুণ বেশি) কাছাকাছি। এই প্রবল চাপ সেখানের লোহার তাপমাত্রা খুব বেশি থাকলেও লোহাকে তার তরল দশায় পরিবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, পরিবর্তে লোহা কঠিন দশাতেই থেকে যায়। সাধারণত যে-কোনো ধাতুর উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে তার তরলে পরিণত হবার তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। ঠিক এই ঘটনাটিই এখানে ঘটছে। পৃথিবীর কেন্দ্রের এই অংশটিকে বলা হয় সলিড ইনার কোর। এর বাইরের স্তরটি আছে তরল দশায়, এবং তা মূলত লোহা দিয়েই তৈরি। একে বলা হয় লিকুইড আউটার কোর। এরপরে থাকে ম্যান্টেল নামে আরেকটি আস্তরণ যা মূলত কঠিন শিলা দিয়েই তৈরি। ইনার কোর এবং আউটার কোর তৈরি হয় মূলত লোহা দিয়ে। আমরা পৃথিবীর মূলত যে চুম্বকত্ব অনুভব করি তার কারণ কিন্তু লুকিয়ে আছে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত এই লোহার জন্যেই। তবে কীভাবে এই লোহা থেকে চুম্বকত্ব তৈরি হয় সেই বিষয়টি একেবারেই সহজ সরল নয়। তা নিয়েই আমাদের পরের অংশের আলোচনা।

২০২২ সালের মাত্র কয়েক বছর আগেই গ্রিনল্যান্ডে প্রাপ্ত শিলার উপর গবেষণা চালিয়ে জানা গেছে পৃথিবীতে চুম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে থেকে। এর আগে অবধি এই ধারণা ছিল যে পৃথিবীতে চৌম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন বছর থেকে। একধাক্কায় পৃথিবীতে চৌম্বকত্বের উপস্থিতি প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পিছিয়ে গেল। প্রশ্ন উঠতেই পারে কবে থেকে পৃথিবীতে চৌম্বকত্ব উপস্থিত আছে সে নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন? সেই মাথাব্যথারও বিশেষ কারণ আছে। সেটা বলে নিয়ে এগিয়ে যাই। এই মতবাদটি সাধারণত অনেকেই মেনে নেন যে, পৃথিবীতে চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটি চাদরের মতন কাজ করে। সূর্য থেকে যেসমস্ত শক্তিশালী কণা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে, যাদের উপস্থিতি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং জলের জন্যে বেশ ক্ষতিকারক। বায়ুমণ্ডল এবং জল না থাকলে আদৌ এই নীল পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হত কিনা সেটাই প্রশ্ন। তাই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতির জন্যেই নীল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং জলের অস্তিত্ব এখনও আংশিক বজায় আছে। সূর্য থেকে যেসমস্ত শক্তিশালী কণা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে তাদের থেকে আগলে রাখে একটি দুর্গের মতন পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র। তাই প্রাণের উৎস জানতেই পৃথিবীর চুম্বকত্ব কবে থেকে আছে সেই তথ্য সঠিকভাবে জানা দরকার। তা জানতে পারলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কিত বহু গবেষণার কাজে সুবিধা হবে। বর্তমান অন্বেষণ থেকে এটা বলা যায় পৃথিবীতে চুম্বকত্বের উপস্থিতি ঠিক কোন সময় থেকে সে ধারণা এখনও পরিষ্কার নয়। এর থেকেও যা অজ্ঞাত, তা হল, পৃথিবীর চুম্বকত্বের আসল কারণ কী।

পৃথিবীর চুম্বকত্বের উপস্থিতির কারণ সম্পর্কিত খোঁজ কিন্তু আজকের নয়। বহু পণ্ডিত এর উত্তর জানার চেষ্টা করেছেন। উইলিয়াম গিলবার্ট, আন্দ্রেই মেরি অ্যাম্পিয়ার, রনে দেকার্তে, এডমন্ড হ্যালি, কার্ল গাউস, লর্ড ব্ল্যাকেটের মতন আরও অনেকে পৃথিবীর চুম্বকত্বের উৎপত্তির কারণ জানবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রয়োগমূলক। কারণ সমুদ্রে নেভিগেশনের জন্যে, জাহাজ এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাবে কী করে যদি সেই তথ্য সঠিকভাবে না জানা থাকে। বর্তমানে কম্পাসের মাধ্যমে দিকনির্ণয়ের খুব একটা প্রয়োজন আর নেই, যদিও। মানুষের পাঠানো উপগ্রহের মাধ্যমে আমরা সহজেই নেভিগেশন করতে পারি। ঘর থেকে বেরিয়ে একেবেঁকে কত কিলোমিটার দৌড়ে এলাম তা থেকে শুরু করে, জাহাজ কীভাবে চলবে, উড়োজাহাজ কীভাবে উড়বে, কোন পথ দিয়ে নিরাপদে যাবে, আমদের গাড়ি কোন রাস্তা দিয়ে যাবে, আজ সবই মানুষের আঙুলের টোকায় ঠিক করা যায় এবং তার স্থানাঙ্কও পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের এত প্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, একটি অত্যন্ত সহজ প্রশ্ন, যা আমাদের এখনও ভাবাচ্ছে, কেন চুম্বকশলাকা উত্তরদিকে মুখ করে থাকে। আজ অবধি এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, বিস্তর ধারণাও আমাদের আছে, তবে বলিষ্ঠ কোনো উত্তর মজুত আছে কিনা সেটাও একটি মূল প্রশ্ন।

পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে আছে ধাতব লোহার একটি কঠিন বল, যার তাপমাত্রা ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। প্রচণ্ড চাপে থাকার জন্যে পৃথিবীর কেন্দ্রের লোহা কঠিন দশায় থাকে। তাপমাত্রা এত বেশি বলে লোহা ফেরোম্যাগনেটিক দশায় থাকতে পারবে না। কারণ এই তাপমাত্রা কুরী তাপমাত্রার অনেক উপরে। কুরী তাপমাত্রার উপরে গেলে ধাতু তার নিজস্ব চুম্বকত্ব হারিয়ে ফেলে। কেন্দ্রের বাইরের স্তরে আছে তরল লোহার আরেকটি স্তর। কেন্দ্রে লোহা কঠিন অবস্থায় থাকার জন্যে, এবং তাপমাত্রা খুব বেশি বলে স্বাভাবিক কারণেই পৃথিবীর চুম্বকত্বের জন্যে সে দায়ী হতে পারে না। চুম্বকত্ব তাহলে নিশ্চিত উৎপন্ন হয় কেন্দ্রের বাইরের স্তরের উপস্থিত কোনো কারেন্টের জন্যে, এবং যা স্থায়ীভাবে বর্তমান। সেই যুক্তিতেও নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা থেকে যায় তা হল, সেই স্তরে উৎপন্ন হওয়া কারেন্ট ওহমিক ডিসিপেশনের জন্যে তার স্থায়িত্ব খুব বেশি হলেও ২০০০০ বছরের বেশি হবার কথা নয়। অথচ বাস্তবের পরীক্ষা এবং প্রামাণিক তথ্য, যা লাভা এবং পলি থেকে পাওয়া যায়—যাকে বলা হয় প্যালিওম্যাগ্নেটিক রেকর্ডস—তা নির্দেশ দেয় যে পৃথিবীর চুম্বকত্বের অস্তিত্ব লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। তাই যেমন ধাঁধা কিন্তু তেমনই থেকে গেল। উত্তর, সহজ নিশ্চয় কিছু একটা প্রক্রিয়া সেখানে কাজ করছে, যা ওহমিক ডিসিপেশনের বিরুদ্ধে কাজ করে, এবং উৎপন্ন চুম্বকত্বকে স্থায়ীভাবে থাকতে সাহায্য করে। ওহমিক ডিসিপেশন বলতে বোঝায় একটি পদার্থের মধ্য দিয়ে যখন কারেন্ট প্রবাহিত হয় তখন প্রবাহিত কারেন্ট, মানে ইলেকট্রনের স্রোত, ইলেকট্রনগুলি প্রবাহিত হবার সময়ে ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হয়, এবং বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে তৈরি হয় উত্তাপ। এ অনেকটা জুল হিটিং-এর সমতুল্য। এখানে বলে রাখা দরকার, প্যালিওম্যাগনেটিক রেকর্ড আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়, তা হল, পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর চুম্বকত্বের দিকও পরিবর্তিত হয়েছে, এবং এই পরিবর্তন খুব একটা যে নিয়ম বা প্যাটার্ন মেনে চলেছে তাও আবার নয়। দিক পরিবর্তন বলতে, এখন যেমন কেউ যদি একটি কম্পাসকে ধরে, তাহলে সেই কম্পাসের উত্তর দিক উত্তরেই থাকবে, কিন্তু পৃথিবীর চুম্বকত্বের দিক পরিবর্তন হওয়া মানে, সেই চুম্বকশলাকার উত্তর দিক আর উত্তর দিকে থাকল না, সে অন্যদিকে ঘুরে থাকবে। মজার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠলে এবং দেখলে চুম্বকশলাকার উত্তর দিকটি যেদিকে সাধারণত নির্দেশ করে থাকে, তা না থেকে অন্য কোনো দিকে নির্দেশ করে আছে। বিষয়টি না জানা থাকলে মনে হবে আমাদের অবস্থানের দিকটাই যেন কেমন উলটে গেল। মানে সূর্য পূর্ব দিকে না উদিত হয়ে পশ্চিমে হল। শেষবার যখন পৃথিবীর এই চুম্বকত্বের উলটে যাবার ঘটনাটি ঘটেছিল তা আজ থেকে প্রায় সাত লক্ষ আশি হাজার বছর আগে। পৃথিবীর ৪.৫ বিলিয়ন বছর বয়সের মধ্যে কয়েকশোবার এই চুম্বকত্ব উলটে যাবার ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু বিগত ৭৮০০০০ বছরের মধ্যে তা আর ঘটেনি। যদি গড় দেখা হয় তাহলে প্রতি ২৫০০০০ বছর অন্তরে চুম্বকত্বের উলটে যাবার ঘটনাটি ঘটবার কথা। এরই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পৃথিবীর চুম্বকত্ব প্রায় ১০ শতাংশ কমে গিয়েছে ১৮৩০ সালের তুলনায়। আমরা যদি ধরেও নিই খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই চুম্বকত্ব কমছে, তাও প্রায় ২০ গুণ বেশি হারে এই দুশো বছরে পৃথিবীর চুম্বকত্ব হ্রাস পেয়েছে। তাহলে এর থেকে যে প্রশ্নটি এখানে উঠে আসছে তা হল, এই চুম্বকত্বের যে হ্রাস হল তা কি নেহাতই পৃথিবীর চুম্বকত্বের শুধুমাত্র ওঠা-নামা, নাকি পৃথিবীর চুম্বকের দুই মেরুর আবার উলটে যাবার সময় এসেছে?

এখানে বেশকিছু প্রশ্ন থাকছেই যখন এই চুম্বকত্বের দিকটি পরিবর্তিত হয়েছে তা কি ধীরে ধীরে হয়েছে, না খুব দ্রুত হয়েছে? এই উলটে যাবার সময়ে চুম্বকক্ষেত্র কি একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল? মোদ্দা কথা হল, সব মিলিয়ে-মিশিয়ে বিষয়টি বেশ ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। বর্তমান পরিস্থতি অনুযায়ী পৃথিবী কোনো একটি দণ্ডচুম্বক নয়, পরিবর্তে একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেট বা তড়িৎচুম্বক। কিন্তু সেই চুম্বকের কী কারণে উৎপত্তি সেই ধাঁধা রয়েই গেছে।


ধাঁধা রয়ে গেছে এটা যেমন সত্যি, তবে মঞ্চ একবারে শূন্য তাও সঠিক নয়। পরিবর্তে অগ্রগতি বেশ অনেকটাই। প্রচলিত মতবাদ এবং তত্ত্বের মধ্যে অন্যতম হল জিও-ডায়নামো তত্ত্ব, যা দিয়ে পৃথিবীর চুম্বকত্বের কারণকে ব্যাখ্যা করা যায়। সাধারণ ডায়নামোর কী করে কাজ করে বা তার মূলনীতি আমাদের কাছে খুব অপরিচিত নয়। একটি দৈনিক উদাহরণ হল সাইকেলের চাকায় যেভাবে ডায়নামো লাগানো থাকে, সাইকেলের চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সেই ডায়নামো তৈরি করে ইলেক্ট্রিসিটি। তা থেকে সাইকেলের জন্যে প্রয়োজনীয় আলো জ্বলে। বিষয়টি আর কিছুই নয়, ডায়নামোর মধ্যে থাকে একটি স্থায়ী চুম্বক, সাইকেলের চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সেখানে থাকা চুম্বকও গতি পায়, এবং এর থেকেই তৈরি হয় তড়িৎশক্তি। একটি ডায়নামোর কাজ মূলত তড়িৎ এবং চুম্বকশক্তি উৎপাদন করা। তবে সাধারণ ডায়নামোতে যেমন থাকে অসংখ্য তারের কুণ্ডলী, পৃথিবীর ক্ষেত্রে তার কেন্দ্রের বাইরের স্তরে থাকে মূলত উত্তপ্ত তরল লোহার একটি সমুদ্র। তরল লোহার আছে প্রচণ্ড ঘুর্ণনবেগ, যাকে বলা হয় সার্কুলার মোশন, এবং এরাই ইলেক্ট্রিকাল কন্ডাকটিং ফ্লুইড। এই ইলেক্ট্রিকাল কন্ডাকটিং ফ্লুইডই পৃথিবীর চুম্বকত্বের জন্যে মূলত দায়ী, এবং যা তৈরি করে একটি জিও-ডায়নামো।

বর্তমানে মানুষের তৈরি করা এবং পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহ আমাদের জীবনের সঙ্গে আমরা না জানলেও বিশেষভাবে জড়িয়ে থাকে। দূরভাষে কথা বলা থেকে শুরু করে, দূরদর্শনে সংকেত পাঠানোর জন্যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, নেভিগেশন, তথ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর, বিনিময়, ব্যবস্থাপন, ক্লাইমেটের পরিবর্তনের জন্যে তথ্য, যেমন সাগর মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা, সেই জলের কারেন্ট, পৃথিবীর ভিতরে কোথাও জলের অস্তিত্বের খোঁজ, খনিজের খোঁজ, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা—এইগুলি কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের কয়েকটি মূল কাজ হলেও, বর্তমানে পৃথিবীর উপরিতলে চুম্বকত্বের বিস্তার এবং তা সময়ের এবং স্থানের সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তার যথাযথ ছবিও আজ তৈরি করা সম্ভব। এতে সুবিধা পৃথিবীর উপরিতলে চুম্বকত্বের যথাযথ একটি ম্যাপ তৈরি করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর উপরিতলে চুম্বকত্ব কী পরিমাণে পরিবর্তিত হল, তারও একটি সঠিক তালিকা আজ বিজ্ঞানীদের হাতে রয়েছে। ফলত যেসমস্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর চুম্বকত্ব উৎপত্তির বিভিন্ন মডেল তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আজ নতুনভাবে কাজ করারও সুযোগ এসেছে। এরই সঙ্গে জিও-ডায়নামো মডেল সিস্টেম পরীক্ষাগারে তৈরি করে, তাতে পরীক্ষা চালনা করে, উন্নত এবং অধিক শক্তিশালী কম্পিউটারের মাধ্যমে পৃথিবীর চুম্বকত্বের অস্তিত্বের কারণ খুঁজতে বহুলাংশে সাহায্য করবে, তা ভরসা নিয়ে বলা যায়। এতে সুবিধা হবে কী করে পৃথিবীর চুম্বকত্বের মেরু পরিবর্তিত হয়েছে, এবং আগামীতে কখন আবার সেই মেরু পরিবর্তিত হতে পারে সেই সংক্রান্ত অনেক তথ্য কিছুটা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যাবে।

গত শতাব্দীতে পদার্থবিদের যে-কোনো গ্রহের চুম্বকত্বের অস্তিত্বের জন্যে প্রধান কারণগুলি চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে প্রথমটি বিরাট আয়তনের পরিবাহী তরল, যেমন পৃথিবীর ক্ষেত্রে, উত্তপ্ত তরল লোহার আধিক্য পৃথিবীর কেন্দ্রের ঠিক বাইরের স্তরে। এই উত্তপ্ত তরল লোহা একদিকে কঠিন উত্তপ্ত লোহার বল, যা একবারে পৃথিবীর কেন্দ্রে, এবং সেই তরলের উপরে কঠিন শিলার একটি মোটা স্তর, এবং তার উপরে আমাদের উপরিভাগ এবং সমুদ্র, মহাসমুদ্র ইত্যাদি। তবে কেন্দ্র কঠিন লোহা হলেও মূলত চাপের আধিক্যে, কিন্তু তাপমাত্রা প্রায় সূর্যের উপরিতলের তাপমাত্রার সমতুল। এই বিশেষ একটি পরিস্থিতি পৃথিবীর ভিতরে তৈরি করে কিছু অদ্ভুত পরিবেশ তরল উত্তপ্ত লোহার জন্যে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। একটি ইলেক্ট্রিক হট প্লেটের উপর যদি তৈরি হওয়া তরল ডালভর্তি পাত্রকে বসানো হয়, যার তাপমাত্রা সেই হট প্লেটের থেকে অনেক কম, তাহলে হট প্লেটের সংস্পর্শে থাকা ডাল তার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্যে কিছুটা গতিশক্তি পাবে, যা সাহায্য করবে তরল ডালকে হট প্লেটের সংস্পর্শ থেকে উপরের দিকে উঠে আসতে। পৃথিবীর কেন্দ্রের তরল উত্তপ্ত লোহার ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ঘটে। একবারে কেন্দ্রের উত্তাপ নিয়ে তার কাছাকাছি থাকা তরল লোহা উপরের দিকে আসতে শুরু করে, মানে যে মোটা শিলার আবরণ, এবং যার তাপমাত্রা বেশ কম। যত উপরের দিকে সেই তরল লোহা আসতে থাকে, ততোই তার আবার তাপমাত্রা কমতে শুরু করে, কারণ সে তখন আসে তুলনামূলক ঠান্ডা পদার্থের সংস্পর্শে। এতে যা ঘটে তাপমাত্রা কমার সঙ্গে তার ঘনত্ব বাড়তে থাকে, সেই তরল অপেক্ষাকৃত ভারী হয়, যা আবার সেই স্তরের তরলের মধ্যে ডুবে যায়, এবং নীচের দিকে আসতে শুরু করে। এই ঘটনাটি ক্রমাগত পৃথিবীর মধ্যে ঘটে চলেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি পরিবাহী তরলের প্রবাহ সর্বদা পৃথিবীর ভিতরে উপস্থিত। এবং তা আছে, পৃথিবীর অভ্যন্তরে লোহা আজও উত্তপ্ত বলেই।

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page